ফেমিনিস্ট অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ (ফ্যাব) হলো বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে বসবাসরত প্রগতিশীল ও বিউপনিবেশবাদী নারীবাদীদের একটি উন্মুক্ত মঞ্চ। আমরা যেসকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তার অন্যতম হলো নারীপুরুষের দ্বিবিভাজনভিত্তিক পিতৃতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্জনবাদী জাতীয়তাবাদ, সামরিকীকরণ, ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস ও মতামতের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ, অসহিষ্ণুতা, সহিংসতা এবং সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ।
একটি রূপান্তরিত ও নতুন বাংলাদেশের পত্তনের সাক্ষী হতে পেরে আমরা পুলকিত। আমাদের তরুণ প্রজন্মের সৃজনশীল ও অদম্য সাংগঠনিক উদ্যম আমাদেরকে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমরা এমন একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যা নারীপুরুষের দ্বৈরথে সীমাবদ্ধ পিতৃতান্ত্রিক, ঔপনিবেশিক, নয়া-ঔপনিবেশিক এবং পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্ত। আমরা এমন একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে সকল লিঙ্গপরিচয় এবং যৌনরুচির মানুষের মধ্যে সাম্য থাকবে এবং যেখানে লিঙ্গবৈচিত্র্য ও লৈঙ্গিক স্বাধীনতা উদযাপিত হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মুক্তি পাবে। আমরা এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে সকল সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ সবাই নিপীড়ন ও বৈষম্য থেকে মুক্তিলাভ করবে।
স্বপ্নের এই বাংলাদেশকে বাস্তবে রূপ দিতে আমরা – প্রগতিশীল ও বিউপনিবেশবাদী নারীবাদীরা – কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রস্তাব করছি। আমরা বিশ্বাস করি, রাজনীতিহীন প্রতিনিধিত্ব আদতে অকার্যকর আর প্রতিনিধিত্বহীন রাজনীতি সার্বজনীন অংশগ্রহণের পথকে আরো সংকীর্ণ করে। নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তুলনামূলক বৈচিত্র্যময়তাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে আমাদের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ অর্জনে প্রয়োজন আরো অনেককিছু।
- আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এমন উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি যা ভবিষ্যতে স্বৈরশাসনের উত্থানকে বাধাগ্রস্ত করবে। সংবিধানের যেসব ফাঁকফোকর অতীতে সামরিকবাদী ও স্বৈরাচারী শাসনের উত্থান ও বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে সেগুলো দূর করতে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিটি নির্বাচন যাতে সকলের সমান অংশগ্রহণে, অবাধে ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
- আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যেন তারা জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে জুলাইয়ের গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দ্রুত, বিস্তারিত, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করে এবং অপরাধীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনে।
- ক্রান্তিকালীন সময়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির আবির্ভাবের সাথে সাথে নারী, ট্রান্স ও হিজড়া, কুইয়ার এবং অন্যান্য লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হচ্ছে। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি তারা যেন ঘৃণা ছড়ানো বিভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ এই বিপন্ন জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেন এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাথে সংলাপ শুরু করেন।
- আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি তারা যেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা ও সহযোগিতা দেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন এবং যারা ইতোমধ্যে বৈষয়িক ও মনোদৈহিক ক্ষতিসাধন করেছে তাদের শাস্তির আওতায় আনেন।
- আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর সহিংস বাঙালি সেটেলারদের ঔপনিবেশিক দমন-পীড়ন বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা আদিবাসীদের ভূমি, জীবন ও সম্পদের দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক ও সামরিকতান্ত্রিক ধ্বংসযজ্ঞের অবসান দাবি করছি।
- আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সরকারি খাতকে পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্গঠন করার এবং বেসরকারি খাতের অনিয়ন্ত্রিত সম্প্রসারণকে প্রতিহত করার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের জনশিক্ষা, জনস্বাস্থ্যসেবা এবং গণপরিবহন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ বরাদ্দের দাবি জানাই।
- আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপন্ন জনগোষ্ঠীসমূহের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা তাদের জরুরি খাদ্য সহায়তা, বেকারত্ব বিমোচন, প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সহযোগিতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এবং সার্বজনীন বার্ধক্য ও অবসর গ্রহণের সুযোগসুবিধা প্রদানের জন্য পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের আহ্বান জানাচ্ছি।
- আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিদ্যমান শ্রম আইন এবং শ্রমিকদের শ্রম অধিকার রক্ষা ও জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, শোভন এবং নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা, ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে বাধা অপসারণ এবং সকল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য জাতীয় পর্যায়ে ন্যূনতম জীবনযাত্রার উপযোগী মজুরি শুরু করার আহ্বান জানাচ্ছি।
- আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্বল্প কার্বন নিঃসরণ-উপযোগী করে তুলতে এবং জনসাধারণের জন্য নির্মল বাতাস, পানি ও পরিবেশের অধিকার নিশ্চিত করতে। এই প্রক্রিয়ায় আমরা যেন ক্রমান্বয়ে কার্বন নিঃসরণকে শূন্যে নামিয়ে আনতে পারি এবং গ্যাস, কয়লা এবং জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে ধীরে ধীরে অ-পারমাণবিক, পরিষ্কার ও নবায়নযোগ্য শক্তির বিভিন্ন উৎসে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারি। আমরা চাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন বিশেষত সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য প্রকৃতিবান্ধব কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সুযোগের প্রসারকে উৎসাহিত করে।
- আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ সকল দমনমূলক আইন সংশোধন এবং সকল প্রকার ডিজিটাল নজরদারি বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি এইসব আইন ও নজরদারি একদিকে যেমন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মর্যাদার অন্তরায়, অন্যদিকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার ব্যর্থতা ও সরকারের চরম নিপীড়নের পরিচায়ক। আমরা নিরাপদ ও সাম্যতাপূর্ণ ডিজিটাল পরিসর নিশ্চিত করতে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে অপতথ্য এবং সহিংসতার বিস্তারে নজর রাখতে প্রযুক্তি-বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজের সদস্য, শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিকদের সমন্বয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গঠনের আহ্বান জানাই। এই সংস্থা দেশব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন, স্বচ্ছ ও নিরাপদ ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) কার্যক্রমও পর্যবেক্ষণ করবে।
- আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহের সযত্ন সংরক্ষণ এবং প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক আখ্যানসমূহের পুনর্লিখনের পথ করে দিতে অনুরোধ করছি। স্বৈরশাসনের পতনের পর ভাস্কর্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা স্বীকার করি যে নিপীড়ন ও বৈষম্যের ইতিহাসের মূর্ত প্রতীক ঔপনিবেশিক বিভিন্ন নিদর্শন ধ্বংস করা প্রতিরোধের এক ধরনের প্রকাশভঙ্গি হতে পারে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক প্রমাণ মুছে ফেলা, কট্টর আদর্শের প্রতিষ্ঠা বা স্রেফ নতুন পাওয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে দেশব্যাপী ঐতিহাসিক ও শৈল্পিক নিদর্শনগুলো নির্বিচারে ধ্বংস করা নতুন বাংলাদেশের উজ্জ্বল স্বপ্নকে ধারণ করে না এবং এখানে জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ কাম্য।
- আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রগতিশীল শক্তি ও তরুণদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন ও সফলভাবে প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় সময়, স্থান ও সম্পদ সরবরাহের আহ্বান জানাচ্ছি। খুব শিগগিরই নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন, কারণ এতে প্রতিষ্ঠিত কোনো রাজনৈতিক দলের হাতে লাগামহীন ক্ষমতা হস্তান্তর করার সমূহ সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে, যার ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নষ্ট হবে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের সংগঠিত হওয়ার জন্য আরও সময় প্রয়োজন।
সবশেষে আবারো বলতে চাই: প্রগতিশীল এবং বিউপনিবেশিক নারীবাদী হিসেবে আমরা একটি সমতাভিত্তিক বাংলাদেশের কথা বলব, যেখানে লিঙ্গ, যৌনরুচি, শ্রেণি, বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা, ভাষা, গায়ের রঙ, বয়স, প্রতিবন্ধিতা বা ভৌগলিক অবস্থান নির্বিশেষে মানুষ পূর্ণ স্বাধীনতা, সাম্য এবং ন্যায়বিচার পাবে। আর সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু করার সময় এখনই।