যৌনকর্মীদের উপর নির্যাতন বন্ধে চাই সরকারি হস্তক্ষেপ
সংবাদ সম্মলেন
৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
স্থান: আব্দুস সালাম হল, জাতীয় প্রেসক্লব
সেক্সওয়ার্কারস নেটওয়ার্ক
প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,
সেক্সওয়ার্কারস নেটওয়ার্ক-এর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাই। নৃবিজ্ঞানের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে আদি পেশা হলো যৌনপেশা। যৌনকর্ম বিভিন্নরূপে প্রাচীনকাল থেকেই চর্চা হয়ে আসছে। জানা যায়, আদিম সমাজেও লেনদেনমূলক যৌনতা পেশা ছিল। পতিতাবৃত্তি প্রাচীন, মিশর এবং গ্রীসে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল, যেখানে এটি বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক স্তরে প্রচলিত ছিল। গ্রিসের হেতারা এবং জাপানে গেইশাকে তাদের সাহচর্যের উচ্চস্তরের প্রশিক্ষণের জন্য সমাজের মর্যাদাপূর্ণ সদস্য হিসাবে দেখা হতো যারা যৌন পরিষেবা প্রদানের পাশাপাশি একজন শিল্পী, বিনোদনকারী এবং কথোপকথনকারী হিসাবে কাজ করেছিল। পতিতাবৃত্তির প্রতি মনোভাব ইতিহাসের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে নানাভাবে যৌনকর্মীদের মানবাধিকার লংঘিত হয়েছে, যৌনকর্মীরা হচ্ছে অমানবিক নির্যাতনে শিকার। বর্তমানেও যৌনকর্মীদের শ্রমের উপর নির্ভর করে এই ব্যবসা ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবী জুড়ে এবং চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। এই পেশার ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই সমাজই তার প্রয়োজনে এই পেশার সৃষ্টি করেছে। স্থান ও কালের ব্যবধানে ব্যবসার নিয়ম-নীতি পালটেছে, ব্যবসার পরিচালনা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে। তবে এই কাজের সাথে সংশ্লিষ্টরা আজও রয়ে গেছে অবহেলিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত।
সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
আমাদের সমাজে নারীরা অভাবের তাড়নায় এবং পারিবারিক ও সামাজিকভাবে প্রতারিত হয়েই মূলত যৌনপেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়। বারবার আন্দোলনের ফলে বর্তমানে স্বাস্থ্য ও আমাদের সন্তানদের শিক্ষা বিষয়ে খুব সামান্য ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে সত্য। তবে আমাদের নেই কোনো নিরাপদ আশ্রয়। এখনও আইনগতভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছি প্রতি পদে পদে। আমাদের উপার্জিত অর্থে ভাগ বসায় বাড়িওয়ালা থেকে শুরু করে সরকারি প্রশাসন, দালাল, মাস্তানসহ সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। অনেকক্ষেত্রে অপ্রাপ্ত/অল্পবয়স্ক মেয়েদেরকে সমাজের প্রতারকশ্রেণি বিভিন্ন অপকৌশলে যৌনকাজে বাধ্য করে। পরবর্তীতে সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরে যেতে পারে না। অতঃপর বাধ্য হয়েই তারা যৌনকাজকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়।
শুচি-অশুচির প্রশ্ন তুলে সমাজ পরিচ্ছন্নতার নামে সমাজ, সংসার, সরকার, ধর্ম সকলেই আমাদের অবাঞ্ছিত মনে করে। তাই যখনতখন উচ্ছেদ কিংবা উচ্ছেদের চেষ্টা করে। অথচ এ কেমন প্রহসন যে যাদের কারণে আজ আমরা এ পথে আসতে বাধ্য হয়েছি তারা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশায় অবস্থান করছেন সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে পূর্ণ মর্যাদা ভোগ করে যাচ্ছে। কেউ কখনও তাদের চিহ্নিত করা বা সমাজ থেকে উচ্ছেদ করার কথা ভাবছে না। তাই সমাজ ও পরিবার যখন আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে, সরকার যখন নির্যাতিতকে অবহেলা করে নির্যাতনকারীর পক্ষ নিয়ে তাদের সুরে সুর মিলিয়ে, পুনর্বাসনের নামে উচ্ছেদের মাধ্যমে আমাদের ঠেলে দেয় আরও বেশি নির্যাতনের দিকে এবং অন্য পেশার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি ও নিরাপত্তা বিধানে অপারগ হয়, তখন স্বভবতই প্রশ্ন জাগে এদেশের নাগরিক হয়েও এই পেশাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকা এবং সন্তানদের আলোর পথ দেখানোর চেষ্টা করা কি আমাদের অপরাধ?
অথচ বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে কোথাও যৌনপেশাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে মহামান্য হাইকোর্ট (রিট পিটিশন নং ২৮৭১/১৯৯৯) এক রায়ে বলেন, “যৌনকর্মীরা স্বেচ্ছায় যৌনমিলনে সম্মতি প্রদান করে এবং সমাজ স্বীকৃত পেশা না হলেও আইনে কোথাও যৌনপেশাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি।” উক্ত রায়ে হাইকোর্ট আরও বলেন, “যদিও যৌনপেশা বাংলাদেশে সমাজ-স্বীকৃত পেশা নয়, কিন্তু যৌনপেশায় প্রবেশের জন্য তারা প্রথমে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে যৌনকর্মী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়, কখনো কখনো যৌনপেশায় নিয়োজিত হবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে এফিডেভিট করে এবং এভাবে যৌনপল্লীতে প্রবেশ করে এবং তাদের পেশা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাবার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন থেকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পেয়ে থাকে। সাপ্রেসান অব ইমমরাল ট্রাফিক এ্যাক্ট ১৯৩৩ (Suppression of immoral traffic Act 1933) এভাবে প্রযোজ্য থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করে যাচ্ছে, যা নিষেধাজ্ঞামূলক কোনো আইনের অনুপস্থিতিতে, রাষ্ট্র সংরক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১ নং অনুচ্ছেদে স্বীকৃত মানবসত্তার মর্যাদা সংক্রান্ত অধিকারটি আদালতে বলবৎযোগ্য না হলেও যৌনকর্মীরা নাগরিক হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত বলবৎযোগ্য অধিকারগুলো ভোগ করবার অধিকারী। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উলেখ্য যে, সাপ্রেসান অব ইমমরাল ট্রাফিক আক্ট ১৯৩৩ (Suppression of immoral traffic Act 1933) -এ যৌনপল্লী পরিচালনা বা যৌনপল্লী হিসেবে ঘর-বাড়ি ভাড়া দেওয়াকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হলেও আইনে কোথাও যৌনপেশাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। উপরন্তু আদালত উক্ত রায়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের গোপনীয়তা রক্ষা সংক্রান্ত ৪৩ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ করে মনে করিয়ে দেন যে, আইনানুগ ক্ষেত্র ব্যতীত কেউ কোনো বাড়ির বাসিন্দাদের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করতে পারে না বা সেখানে অনধিকার প্রবেশ করতে পারে না। অন্যদিকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ নং অনুচ্ছেদের ধারা – ২ এ বলা হয়েছে ”গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।”
সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
আপনারা অবগত আছেন যে, বিগত ২৯ অগাস্ট, ২০২৪-এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি নির্মম ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে দেখা যায় একজন যুবক শ্যামলীতে ভাসমান যৌনকর্মীদের উপর নির্বিচারে নির্মম ভাবে লাঠিপেটা করে। শুধু লাঠিপেটা নয় এই ভাসমান যৌনকর্মীদের সাথে থাকা নগদ অর্থ এবং মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। ভাইরালকৃত ভিডিওটির কারণে একজন যৌন কর্মীর সন্তান ট্রমাটাইজড হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, এতে করে সন্তান ও মায়ের সম্পর্কের মাঝে তিক্ততা, টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে।
পত্র-পত্রিকার বদৌলতে জানা যায় যে, বিভিন্ন এলাকায় যৌনকর্মীদের একদল যুবক সংঘবদ্ধ হয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতন করছে এবং ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যেমন যাত্রাবাড়ি, কোর্ট এলাকায়, শ্যামলী, শহীদ মিনার, মিরপুর মাজার রোড, ফার্মগেট, আসাদগেট, উত্তরা, কুড়িল ও বাড্ডা বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিন যৌনকর্মীদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। এতে করে একাধিক যৌনকর্মী শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
এ প্রেক্ষিতে আমাদের সুনির্দিষ্ট দাবিসমূহ:
১. যৌনকর্মীদের উপর নির্যাতনকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে এবং দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২. যৌনকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং দপ্তরের কার্যকরি ভূমিকা পালন করতে হবে।
৩. স্থানীয় প্রশাসনকে স্থানীয়ভাবে যৌনকর্মীদের সুরক্ষা দিতে হবে।
৪. ব্রথেল উচ্ছেদ বন্ধ করতে হবে।
৫. পুলিশ দ্বারা যৌনকর্মীদের উপর আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।
৬. যৌনকর্মীদের সন্তানদের সুস্থ, নির্বিঘ্ন, মূল স্রোতধারার পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে।
৭. যৌনকর্মীদের কবরস্থানের জন্য কোনো পার্থক্য করা যাবে না। মূল স্রোতধারার/সামাজিক ব্যবস্থায় কবরের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৮. যৌনকর্মীদের নির্বিঘ্ন জীবনযাপন এবং সার্বিক নিরাপত্তার প্রতি উপদেষ্টামণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
৯. যৌনকর্মী নয় বরং মানুষ হিসেবে তাদের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় নিপীড়ণ এবং শোষণ বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১০. সকল ধরনের নারী নির্যাতন এবং যৌন হয়রানি বন্ধে আইনের সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে।
সেক্সওয়ার্কারস নেটওয়ার্কের পক্ষে –
আলেয়া আক্তার লিলি
সভাপতি
সেক্সওয়ার্কারস নেটওয়ার্ক