[এখানে প্রকাশিত লেখার বক্তব্য ও ভাষা আলোচকদের নিজস্ব।]

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতনের পরের বাংলাদেশ নিয়ে কী ভাবছেন নারীবাদীরা? ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চাই আমরা? নারীবাদের চোখ দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা নিয়মিত আলাপে বসার আয়োজন করেছি Feminist Alliance of Bangladesh থেকে। এই ধারাবাহিক আলাপের প্রথম পর্বে ছিলেন তারা আসগর, নাসরিন খন্দকার ও ডালিয়া চাকমা। পরিকল্পনা ও সঞ্চালনায় নাফিসা তানজিম। সমন্বয় ও সম্পাদনায় তৃষিয়া নাশতারান। তারা একজন ট্রান্স-নারী, শিল্পী ও শিক্ষক। ডালিয়া একজন আদিবাসী নারীবাদী। কাজ করছেন সাপোর্টিং পিপল অ্যান্ড রিবিল্ডিং কমিউনিটিজ (SPaRC)-এর জেন্ডার অ্যান্ড ইন্টারসেকশনালিটি লিড হিসেবে। নাসরিন খন্দকার একজন সামাজিক নৃবিজ্ঞানী, গবেষক। নাফিসা পেশায় শিক্ষক ও গবেষক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উইমেন, জেন্ডার এন্ড সেক্সুয়ালিটি স্টাডিজ পড়ান। তৃষিয়া একজন নারীবাদী সংগঠক ও ফোরসাইট  স্ট্র্যাটেজিস্ট।

আমরা সবাই এখন একটা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। স্বাধীনতার স্বাদ আমরা নতুন করে পাচ্ছি। কিছুদিন আগেও ফেসবুকে সরকারবিরোধী কিছু লিখতে গেলে অনেককিছু মাথায় রাখতে হতো। ডিজিটাল সিকিউরিটি  অ্যাক্টের আওতায় অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এমনকি মারাও গেছেন। গত কয়েক সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই স্বৈরশাসনের সমালোচনা করে যত পোস্ট, মিম, গান, কবিতা, কার্টুন এসেছে তা থেকে বোঝা যায় যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শুধু নয়, মানুষ হিসেবে মর্যাদা নিয়ে বাঁচার স্বাধীনতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আশার কথা হলো আমাদের রাষ্ট্রসংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। আমরা এও জানি যে স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা বেশি কঠিন। এঞ্জেলা ডেভিস বলেছেন – “Freedom is a constant struggle.”

স্বাধীনতার এই লড়াইটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এটা চালিয়ে যেতে হয়। এই নতুন দেশের স্বাধীনতা রক্ষার চিন্তা থেকে আমরা কিছু নারীবাদী এক হয়েছি ফেমিনিস্ট অ্যালায়েন্স অফ বাংলাদেশ সংক্ষেপে ফ্যাব নামের একটা প্লাটফর্মে। বাংলাদেশে নারীবাদী সংগঠন অনেক আছে এবং অনেকেই অনেক বছর ধরে অনেক ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। এত সংগঠনের ভিড়ে আমরা কী করতে চাচ্ছি? আমরা সেই অর্থে কোনো সংগঠন নই। আমরা একটা প্লাটফর্ম যেখানে আমরা ,যারা নিজেদেরকে সুনির্দিষ্টভাবে বিউপনিবেশবাদী নারীবাদী (decolonial feminist) মনে করি, তারা যুক্ত হয়েছি। আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নারীবাদী যারা বিষমবাদী পিতৃতন্ত্র (hetero-patriarchy), পুঁজিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, ধর্মীয় সহিংসতা, ঔপনিবেশিকতা (imperialism), নব্য ঔপনিবেশিকতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদ (ultra nationalism)-এর বিরুদ্ধে কথা বলব, যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে সংহতি প্রকাশ করব। আমরা একটি স্বতঃস্ফূর্ত (organic) প্ল্যাটফর্ম। আমরা কোনো এনজিও নই। এনজিও হিসেবে নিবন্ধনের কোনো ইচ্ছা বা সম্ভাবনা আমাদের নেই। যেহতু আমরা কারো থেকে ফান্ড নিই না, সেহেতু কাউকে সন্তুষ্ট করে চলার দায় আমাদের নেই। এখানে আমরা আমাদের মনের কথা স্বাধীনভাবে বলব।

প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতির (Politics of representation) ঊর্ধ্বে যেতে পারা আমাদের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। অনেকসময় দেখা যায় যে আমাদের নারীবাদী চিন্তাগুলো ঘুরে ফিরে বারবার নারী নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা, সিদ্ধান্তগ্রহণে নারীকে যুক্ত করা, সরকারি চাকরিতে নারীর সংখ্যা বাড়ানোর মধ্যে আবদ্ধ রয়ে যায়। হ্যাঁ, নারীর অন্তর্ভুক্তি জরুরি। কিন্তু শ্রেণি, ক্ষমতা বিবেচনা না করে শুধু লিঙ্গপরিচয়ে নারীকে অন্তর্ভুক্ত করলে সুবিধাভোগী শ্রেণির নারীর প্রবেশাধিকার বাড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং তাতে সেই পুরনো ক্ষমতাকাঠামোর চর্চারই পুনরাবৃত্তি হয়। যেই স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটলো তা এই সমস্যার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই আমরা বলতে চাই যে নারীকে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি, কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়। শুধু নারী নয়, নিপীড়নমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে প্রয়োজন প্রান্তিক, বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকেও আলোচনার টেবিলে জায়গা দেওয়া। 

৯ অগাস্ট একটি বিশেষ দিন – আদিবাসী দিবস। এই বিশেষ দিনে ফ্যাবের প্রথম প্যানেল আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল তিনজন দুর্দান্ত নারীবাদীকে নিয়ে। বাংলাদেশে কী হচ্ছে, সামনে কী আছে এগুলো নিয়ে তাদের চিন্তা জানতে চেষ্টা করেছি আমরা। আদিবাসী দিবসে এই আলোচনা আরো প্রাসঙ্গিক, কারণ বিউপনিবেশবাদী নারীবাদী হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি যে আমাদের আদিবাসীদের উপরে যুগের পর যুগ ধরে বাঙালি সেটেলারদের ঔপনিবেশিকতা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পাহাড়ে বাঙালিরা যেভাবে নতুন একটি উপনিবেশ তৈরি করেছে, আদিবাসী ভূমিতেই আদিবাসী জীবনকে যেভাবে দখল করে রেখেছে, আমরা তার অবসান চাই। আমরা চাই আদিবাসী জীবন সেনাশাসন মুক্ত হোক। আমরা চাই আদিবাসী জীবন কর্পোরেশনের পুঁজিবাদী আগ্রাসনমুক্ত হোক। আমরা সংহতি প্রকাশ করছি আমাদের সকল আদিবাসী সাথীদের সাথে যারা তাদের পিতৃতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের নিপীড়ন ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছে। 

নাফিসা: আপনারা যদি সংক্ষেপে নিজেদেরকে পরিচয় করিয়ে দিতেন? 

ডালিয়া: আমি ডালিয়া চাকমা। আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা। শুরুতেই বলে রাখতে চাই যে ইন্টারসেকশনাল লেন্স দিয়ে দেখলে চাকমা কমিউনিটির মানুষ হিসেবে আমি একটা প্রিভিলেজড কমিউনিটির মানুষ। আমাকে দিয়ে যেন বাংলাদেশের সকল আদিবাসীকে এক কাতারে না দেখা হয়। আমি আমার কাজের জায়গা থেকে পার্থক্যগুলো দেখাতে চাই, ‘আদিবাসী’ হিসেবে, আমার চাকমা আইডেন্টিটি থেকে বলবো যে আমি একজন ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিস্ট। আমার কাজের জায়গাটা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমতলে যেসব আদিবাসীরা আছেন তাদের নিয়ে। বাংলাদেশে আমাদের যে না বলা, না বলতে পারা কথাগুলো আছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করছি সাপোর্টিং পিপল এন্ড রিবিল্ডিং কমিউনিটিজের জেন্ডার এন্ড ইন্টারসেকশনাল লিড হিসেবে। 

তারা: আমার নাম তারা আসগর। আমি এখন থাকি নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে। আমি বড় হয়েছি বাংলাদেশে। আমি পড়াশোনা করেছি বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার পরবর্তী শিক্ষাজীবন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি এখন পড়াই এখানকার খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে, একজন প্রফেসর হিসেবে। আর আমার ট্রেনিংটা হয়েছিল আর্টিস্ট হিসেবে। বাংলাদেশে থাকার সময়কাল থেকেই কুইয়ার কমিউনিটি, এলজিবিটিকিউ প্লাস কমিউনিটি, ট্রান্স কমিউনিটির সাথে আমার যোগাযোগ। আমার কাজের বিষয়বস্তু, কাজের উৎসাহ উদ্দীপনার জায়গা সবটাই ছিল কমিউনিটিকেন্দ্রিক। সেখান থেকে আমি খুব উদ্দীপ্ত এবং আমার খুব আগ্রহের জায়গা মাইগ্রেশন, কুইয়্যারনেস এবং ট্রান্সনেস। কীভাবে এগুলো একসাথে ইন্টারসেক্ট করে একটা ডিকলোনাইজড ফেমিনিস্ট পারসপেক্টিভ তৈরি করে সেটা আমার আগ্রহের জায়গা। আজকের এখানে যে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কথা বলার জন্য তার জন্য আমি খুবই আনন্দিত। খুব ভালো লাগছে একসাথে সবার সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়ে। এরকম একটা মুহূর্তে যেই সময় অনেক সোশ্যাল ডায়লগ শুরু করবার চেষ্টা করছি আমরা, নানারকমের ব্যাপারকে সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি আমরা যেগুলো হয়ত গত অনেকবছর বাংলাদেশে সম্ভব ছিল না, বা কথা বলতে গিয়ে আমরা নিজেরা নিজেদেরকে সেন্সর করেছি নানারকমভাবে। আমি কথা বলতে আগ্রহী, কথা শুনতে আগ্রহী, আপনারা যারা শুনতে এসেছেন তাদের মতামত জানতে আগ্রহী। 

নাসরিন: সবাইকে শুভেচ্ছা এবং বিশেষ করে নাফিসা এবং তৃষিয়াকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এই প্লাটফর্মটা তৈরি করবার জন্য এবং সেই সাথে আমাকে এই প্রথম আলোচনাতে অংশ নেবার দাওয়াত দেওয়ার জন্য। সবাইকে আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা এবং অবশ্যই নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখার শুভেচ্ছা। আমি নাসরিন খন্দকার। আমি বর্তমানে আয়ারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজ কর্কে গবেষক হিসেবে আছি। এর আগে আমি বাংলাদেশে আমার সারাজীবন কাটিয়েছি বলতে পারেন। বাংলাদেশে আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান পড়েছি এবং পড়িয়েছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে আমি নয় বছর পড়িয়েছি। তারপরে আমি আয়ারল্যান্ডে এসেছি। সেই সূত্রে আমি নিজেকে সামাজিক নৃবিজ্ঞানী এবং নারীবাদী মনে করি। এখানে বর্তমানে আমার গবেষণার বিষয়ের মধ্যে আছে মাইগ্রেশন, রেসিয়ালাইজেশন, এন্টি মুসলিম রেসিজম, এবং অবশ্যই ফেমিনিজম।

তৃষিয়া: আমি একজন নারীবাদী সংগঠক এবং একজন ফিউচারিস্ট বা অন্যভাবে বললে ফোরসাইট স্ট্র্যাটেজিস্ট। আমার পড়ালেখার একটা অংশ বাংলাদেশের বুয়েট থেকে প্রকৌশলবিদ্যায়, আরেকটা অংশ কানাডার অকাড ইউনিভার্সিটি থেকে স্ট্র্যাটেজিক ফোরসাইট অ্যান্ড ইনোভেশনে। ২০১১ সালে মেয়ে নেটওয়ার্ক নামে একটা সংগঠন শুরু করার মধ্য দিয়ে নারীবাদী হিসেবে আমার যাত্রা শুরু হয়, যেখানে আমি একজন সংগঠক ও সমন্বয়ক হিসেবে আছি। এখন আমার কাজের প্রধান জায়গা জীবনমুখী ইনক্লুসিভ ভবিষ্যত, প্রযুক্তিগত অধিকার ও নারীবাদী আন্দোলন। 

নাফিসা: আমি নাফিসা তানজিম। আমি এখন আমেরিকায় উস্টার স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টে উইমেন জেন্ডার এন্ড সেক্সুয়ালিটি স্টাডিজ পড়াই। আমার বড় হওয়া বাংলাদেশে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ছিলাম এবং তারপরে উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ নিয়ে আরো পড়াশোনা করার জন্য প্রথমে কানাডায় এবং পরে আমেরিকায় আসি। আমার পিএইচডি এবং আমার পরবর্তী গবেষণার ফোকাস হচ্ছে কলোনিয়াল ফেমিনিজম, ট্রান্সন্যাশনাল ফেমিনিজম এবং বিশেষত সোশ্যাল মুভমেন্ট। মানুষ কীভাবে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন করে এটা আমার নিজের ব্যক্তিগত গবেষণার আগ্রহের বিষয়। এছাড়া আমি নিজে স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় আমেরিকাতে ইউনাইটেড স্টুডেন্টস এগেইন্স্ট ওয়েবশতে যুক্ত ছিলাম। তখন বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের সলিডারিটি নিয়ে একটা আন্দোলন হচ্ছিল রানা প্লাজা ধসের পরে। আমি সেখানে জড়িত ছিলাম। বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সাথে অনেকদিন ধরে কাজ করছি। মেয়ে নেটওয়ার্কের একজন সংগঠক হিসেবেও আছি এবং যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষক ইউনিয়নের সাথে আমরা এখানে শিক্ষকদের শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করি। তো এই হচ্ছে আজকে আমাদের পরিচয়।

আজকের আলোচনাটা আলাপের আঙ্গিকে হবে। আমরা তিনটা রাউন্ডে প্রত্যেকের কাছে যাব এবং আমাদের এখনকার সময়ের অবস্থা নিয়ে তারা কী ভাবছেন তা জিজ্ঞেস করব। 

প্রশ্ন-১: আমাদের এখনকার অবস্থায় যে নতুন বাংলাদেশের সূচনা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের যে কাজ চলছে, যেই উদ্যোগগুলো নেওয়া হচ্ছে, যেই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিগুলো তৈরি হচ্ছে তার সার্বিক পরিস্থিতি দেখে আপনি কী ভাবছেন? যেই পরিস্থিতিটা তৈরি হচ্ছে সেটা আপনার জন্য কী বিশেষত্ব বহন করছে? আপনার কমিউনিটির উপর এটার কেমন প্রভাব পড়ছে? বাংলাদেশের মানুষকে এই অবস্থাটা দীর্ঘমেয়াদে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে?

ডালিয়া: সবাইকে আরেকবার শুভেচ্ছা জানাই আদিবাসী দিবসের। আজকে আমি এখানে বলেই হয়ত আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা দিতে পারছি। কয়দিন আগেও আদিবাসী শব্দটা উচ্চারণ করতে আমরা সবসময় একটা ভয়ের মধ্যে থাকতাম এবং এখনো আমার মনের মধ্যে প্রশ্ন আছে। আমাদের মনে আছে যে এই আদিবাসী শব্দটা আমরা সামনে ব্যবহার করতে পারবো কি না তা নিয়ে আমাদের মধ্যে ভয় কাজ করেছে। এ নিয়ে অনেক ধরনের ইম্পোজিশন কাজ করেছে যে শব্দটা ব্যবহার করা যাবে না। সরকারিভাবে তো অবশ্যই। আমি তার চেয়ে বেশি দেখেছি যে এই সমাজের মধ্যে বাংলাদেশকে যদি আমি একটা একটা ফ্রেমের মধ্যে দেখি, আমি দেখতে পাই যে এইখানে এই আদিবাসী শব্দটা ব্যবহার করাটা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করে। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের পেছনে তো অবশ্যই একটা ঐতিহাসিক লিগ্যাসি আছে এই রাষ্ট্রে। বাঙালি ভিন্ন অন্য যে জাতিসত্তাগুলো আছে তাদেরকে কেন আদিবাসী না বলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলতে চায় বা উপজাতি বলতে চায় তার তো অবশ্যই একটা পলিটিক্স আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যারা কিনা এই পলিসি রিফর্মে থাকছেন, আমি যদি তাদেরকে বাদ দিই, যদি বলতে চাই যে একটা জনতার সমাজ, তাহলে সেই জনতার সমাজেও ওই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, উপজাতি শব্দগুলো কেন গৃহীত হবে, কেন এক ধরনের একটা গ্রহণযোগ্যতা থাকবে? কেন বলা হবে যে আমাদের এখানে কোনো আদিবাসী নাই, আমাদের এখানে বাঙালি ভিন্ন যারা আছে, অন্য যেসব জাতিসত্তা আছে তারা হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, উপজাতি? 

তো এই মাল্টিপল জায়গা থেকে যেই ধরনের চিন্তাচেতনা মানুষের মধ্যে কাজ করে সেটা অবশ্যই একটা চিন্তার বিষয়। ওই জায়গা থেকে আমার কনসার্নের জায়গাটা হচ্ছে যে আমরা যখন রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছি, আমরা স্বাধীনতার কথা বলছি, সেই রাষ্ট্র সংস্কারের জায়গায় ডিকলোনিয়াল পরিসরে আমরা যদি দেখতে চাই, তাহলে প্রশ্ন আসে যে আসলে কারা পলিসি রিফর্মেশনটা করবে? ক্ষমতার সাথে যারা যুক্ত, তারা করবে? নাকি সমাজের মানুষও যুক্ত থাকতে পারবে এখানে? এটা দেখা দরকার যে যারা পলিসি রিফর্ম করছে তারা অপর যে মানুষগুলো আছে তাদেরকে কীভাবে দেখছে? এই ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’-তেও কি আমরা উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে থেকে যাব? 

আমি পত্রিকায়, ফেসবুকে দেখতে পাচ্ছি যে মাইনরিটি কমিউনিটিগুলো খুব সহিংসতার শিকার হচ্ছে। তাদের কথা যখন বলা হচ্ছে তখন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, উপজাতি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। হ্যাঁ, তারা হয়ত বলছেন যে উপজাতিদের উপর হামলা বন্ধ করতে হবে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কথা ভাবতে হবে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো এরা ভাবছে না যে আমরা তো চাই না অন্য কেউ আমাদেরকে উদ্ধার করুক। আমরা চাই যে আমরা নিজেরা নিজেদের জন্য করব। আমরা যদি সমতার কথা বলি, স্বাধীন রাষ্ট্রে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলি, তাহলে ৫ অগাস্টের পর এই পরিবর্তনটা আসতে পারত কি না যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি না বলে আদিবাসী শব্দটা ব্যবহার করা হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীনতা উদযাপন করতে পারছেন, নিজেদের স্বাধীন বলে দাবি করছেন। এখানেও যে নারী-পুরুষ এবং বাঙালি পরিচয়ের বাইরে বিভিন্ন পরিচয়ের মানুষ আছে যাদেরকে বিভিন্ন ব্যাকল্যাশের মুখে পড়তে হচ্ছে, তাদের কথা অনেকে ভুলে যাচ্ছে। আমার বন্ধুরা, যারা রাস্তায় আন্দোলনে ছিল, যারা কিনা পুরুষ নন, যারা কিনা বাঙালি নন তাদেরকে কিন্তু হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। যারা ‘প্রান্তিক’ জনগোষ্ঠীর তাদের কিন্তু সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে। এই স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন যখন আমরা দেখতে শুরু করছি এই প্রশ্নগুলোও আমার মনে খুব আসছে। বরং এর আগে তো রাষ্ট্রীয়ভাবে এক ধরনের চাপিয়ে দেওয়া খারিজ করা সত্তার মধ্যে থাকতাম। কিন্তু এখন আমার মধ্যে খুব জোরালোভাবে প্রশ্ন হচ্ছে যে একই স্বপ্ন অন্যদের মতো আমরাও দেখতে পারবো কি না।

তারা: ডালিয়া যেটা দিয়ে শেষ করলেন সেটা দিয়ে আমি শুরু করতে পারি। যে স্বপ্নটা আমরা একসাথে দেখতে চাই সে স্বপ্নটা কি আমি ব্যক্তি হিসেবে বা আমার কমিউনিটি মানে আমার বন্ধু, আমার সহযোদ্ধা, আমার পারিপার্শ্বিকতায়  যারা থাকেন, তারা কি দেখতে পারবেন? প্রশ্নটা শুনে আমার আরো দুটো শব্দ মনে হলো যেগুলো দিয়ে বললে ফ্রেমওয়ার্কটা বুঝতে সুবিধা হবে। একটি হলো প্রেক্ষিত, আরেকটি হলো ট্রিগার। প্রেক্ষিত বিবেচনায় আমি তো আসলে পুরো ব্যাপারটার একজন প্যাসিভ অবজার্ভার (পরোক্ষ পর্যবেক্ষক)। আমি আমেরিকাতে থাকি। আমি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে অভিবাসী হিসেবে থাকি আমেরিকায়। ফলে আমার দেখাশোনার অনেকটাই সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইউটিউব মারফত বা সংবাদ মাধ্যমের এনালাইসিস থেকে পাওয়া। সেখান থেকেও আমাকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে কোনটি আসল সংবাদ, কোনটি নকল সংবাদ, কোনটি কোন দলের মতামত তুলে ধরে, কোনটি আরেক দলের মতামত তুলে ধরে এই যাচাই বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে। নিজের বোধবুদ্ধিতে বুঝতে পারি এটি যে গণমানুষের আন্দোলন সে বিষয়ে আমাদের দ্বিমতের জায়গা নেই। এটি গণজাগরণের একটি অংশ। কিন্তু সেখান থেকেও মনে হচ্ছে যে  প্রকাশ্যে এই গণজাগরণ পদ্ধতিটার ভেতরে আসলে আমার অংশগ্রহণ কতটুকু ছিল, আমার মতো মানুষদের অংশগ্রহণ কতটুকু ছিল। আমার বাঙালি পরিচয় বা মুসলিম পরিচয়ের মধ্য দিয়ে আমি যতটা সহজাতভাবে আড়ালে থেকে এই ধরনের গণজাগরণের অংশ হতে পারছি, আমি কি ট্রান্স বা এলজিবিটিকিউপ্লাস বা নন-বাইনারি মানুষ হিসেবে কি পারছি? নারী বা পুরুষ যেভাবে পারেন সেরকম করে কি একজন ট্রান্স বা এলজিবিটিকিউপ্লাস বা নন-বাইনারি মানুষ পারছেন প্রকাশ্যে রাস্তায় যেতে? হিজড়া মানুষরা কি পেরেছে ছাত্র আন্দোলনে যেতে? পারেননি। তার কারণ অনেক ক্ষেত্রেই তো হিজড়াদের শিক্ষার অধিকারটাই নেই। তার ফলে যে ছাত্র আন্দোলনের কথা বলছি সেই ছাত্রত্বের স্ট্যাটাসটুকুতে যাবার পর্যন্ত অধিকার অনেকটা বড় অংশের কমিউনিটির মানুষের নেই। তাহলে তাদের প্রতিনিধিত্ব আমরা কীভাবে দেখতে পারি? গণমানুষের আন্দোলনের জায়গাতেও এইসময় এইরকমের আন্দোলন এবং সেটার সূত্র ধরে যদি ট্রিগারের কথা বলি – এ ধরনের আন্দোলন একটা ট্রিগার তৈরি করে। বিশেষত ডালিয়া চাকমা যে কথাটা বললেন যে যেকোনো মাইনরিটি কমিউনিটি যাদের বিপন্ন হবার অনেক ব্যক্তিগত এবং কমিউনাল অভিজ্ঞতা আছে অতীতে, তারা আরো বিপন্ন বোধ করেন এসব সময়ে। হয়ত বিপন্ন বোধ করার মতো কোনো সরাসরি আঘাত নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত এবং কমিউনাল অভিজ্ঞতার যে অতীত অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি সেগুলো তখন ট্রিগারড হয়ে একটা ভীতিকর অবস্থার তৈরি করে। তার ফলে আমার এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষিত বিবেচনায় হাসিনার শাসনের সময় এবং আন্দোলনটা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত একদিক থেকে যেমন কমিউনিটির মানুষ বিপন্ন বোধ করেছেন, আন্দোলনটা হয়ে যাবার পর যখন হাসিনার পতন হয়েছে তখনও কিন্তু মনে হয় আরেকটু বেশি বিপন্নই বোধ করেছেন। আমি অন্তত এদেশ থেকে বিপন্ন বোধ করেছি, সবার খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশের মানুষ, কমিউনিটির মানুষ বিপন্ন অনুভূতি নিয়ে দিন কাটিয়েছে, এখনো দিন কাটাচ্ছে। আসলেও যে পরিবর্তনটা দেখতে চাই বা যে পরিবর্তনটা আসবে বলে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ হবে বলে কথা বলা হচ্ছে সেখানে আমাদের অংশগ্রহণের সুযোগ কতটুকু, সুযোগ কি আসলেও আছে নাকি, মানুষ কী করে আমাদের কথা চিন্তা করবে, আগে কি খারাপের মধ্যেও তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় ছিলাম নাকি আরো একটি খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়তে যাচ্ছি এ ধরনের অনেক চিন্তাভাবনা, বিশ্লেষণ, আশংকা সবটা কিন্তু কমিউনিটির মধ্যে রয়ে গেছে।

নাসরিন: অনেক ধন্যবাদ। ইতোমধ্যে ডালিয়া এবং তারা অনেক কিছুই বলে ফেলেছেন আমার যা বলার ইচ্ছা ছিল। প্রশ্নের প্রথম অংশটুকু যদি ধরি যে এই বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি কী ভাবছি, তাহলে বলতে হয় বর্তমান পরিস্থিতি বলতে আমি বোঝাচ্ছি আজকে এবং সেই সাথে গত এক মাস এবং সেই সাথে গত ১৫ বছর। কারণ এই সবটার মধ্য দিয়ে যেই প্রেক্ষাপট তার মধ্য দিয়ে আমরা আজকে আছি এখানে। ফলে আমি এই পুরো পরিস্থিতিতে নাটকীয়ভাবে যে পট পরিবর্তন এবং এত এত রক্তক্ষরণ, এত হত্যা, এত সহিংসতা, এত আন্দোলন, এত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা যে বিজয়টা এনেছে, আমাদের দেশের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে, সেই সুযোগে আমি বলব যে এই মুহূর্তে আমরা সবাই বোধহয় একটা একটা অন্যরকম, একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে আছি। সেই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সবরকমের আবেগ আনন্দ ভয় আশঙ্কা সবকিছু মিলেমিশে একাকার। ফলে এই অনুভূতি থেকে আসলে সবকিছু একসঙ্গে দেখাটাও কঠিন এবং এটা নিয়ে কথা বলাও কঠিন। 

প্রথমে আমি যে জায়গাতে ভর দিয়ে চাচ্ছি তা হচ্ছে যে ছাত্র আন্দোলন নাকি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এটা? আমরা সবসময় ইনক্লুশনের কথা বলছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আমি যখন শিক্ষার্থী  হিসেবে ছিলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল। সেখান থেকে আমরা বলেছিলাম যে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনটা হচ্ছে ধর্ষণবিরোধীর ছাত্রী আন্দোলন। এটা ছাত্র আন্দোলন ছিলো না। আমরা সবসময় সব আন্দোলনকেই ছাত্র আন্দোলন বলে থাকি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আন্দোলনকে ছাত্রী আন্দোলন বলার কারণে এটা অনেক ব্যাকল্যাশের শিকার হয়েছিল। কথা উঠেছিল যে ছাত্র বললে তো সবাইকে ইনক্লুড করা হয়। কিন্তু আমাদের অবস্থান ছিল যে – না, ছাত্র একটি লিঙ্গীয় শব্দ। ছাত্র বললে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। ছাত্র বললেই আমরা একটা পুরুষকে কল্পনা করি। এই ইমেজ থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। ফলে আমরা সবসময় বলছি যে আন্দোলনটা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন,এবং এই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে নারী-পুরুষ সবাই, সমস্ত লিঙ্গের মানুষ এখানে অংশগ্রহণ করেছিল। 

দ্বিতীয়ত আমি আরেকটা জায়গাতে ভর দিতে চাই। সেটা হচ্ছে যে এই আন্দোলনের ব্যানার ছিল বৈষম্যবিরোধিতার। আমি সেখানে সবাইকে বারে বারে ফিরে আসতে বলব। কারণ আমাদের মনে হয় ওইখান থেকে কাজ শুরু করতে হবে, যদিও এই আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল একটা কোটাবিরোধী যে আন্দোলন তার পরিপ্রেক্ষিতে। সেই কোটাবিরোধী অবস্থানের সাথে আমি বৈষম্যকে যুক্ত করতে চাচ্ছি। বিশ্বজুড়ে কোটা সিস্টেমের চলনটা কেন আছে? আছে, কারণ এটি একটি সামাজিক বিচারব্যবস্থা, এক ধরনের সোশ্যাল জাস্টিস থেকে আসা কনসেপ্ট যেখানে বলা হয়েছে যেই জনগোষ্ঠী একটি সমাজে বিদ্যমান ব্যবস্থায় ঐতিহাসিকভাবে নানারকমের কাঠামোগত বৈষম্যের শিকার হন তারা তাদের মেধার বিকাশের জন্য সুবিধাপ্রাপ্তদের মতো সুযোগ পান না। সেই পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করবার জন্য যাদের যারা নানাভাবে সুবিধাবঞ্চিত বর্গের মানুষ তাদেরকে ওই সুবিধাবঞ্চনার একটা ক্ষতিপূরণ হিসেবে কোটাব্যবস্থা চালু করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কোটা ব্যবস্থার অর্থ এবং ব্যবহার সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কোটাকে ধরে নেওয়া হয় সুবিধা হিসেবে। এটা মনে করার কারণ হচ্ছে সুবিধাবঞ্চনা যে একটি কাঠামোগত বৈষম্যের কারণে সমাজে বিদ্যমান এটা দেখতে না পাওয়া। কিছু মানুষ তাদের পরিচয়ের কারণে অনেক বেশি শোষণের শিকার হন, অনেক বেশি সুবিধাবঞ্চিত থাকেন, মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা কখনো তা প্রকাশ করার সুযোগ পান না, আধিপত্যশীল গোষ্ঠী তাদের সুযোগগুলো চুরি করে নেন, দখল করে নেন এই পরিস্থিতিকে, এই বৈষম্যকে দেখতে না পাওয়ার কারণেই বাংলাদেশে কোটার অর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে সুবিধা দেওয়া। আমি ওইখান থেকে কোটাকে, কোটার আসল যে বৈষম্যবিরোধী অবস্থান তাকে উদ্ধার করে আনতে আগ্রহী। 

শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার চেয়েছিল, কারণ কোটার শতকরা ৩০ ভাগ ব্যবহার করা হয়েছিল সুবিধা প্রদানের জন্য। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন তাদের ত্যাগের একটা পুরস্কার হিসেবে তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল এই কোটার ব্যবস্থা। হ্যাঁ, এটা সম্ভব যে যারা কিনা একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন বা হাত-পা হারিয়েছেন, তাদের সন্তান হারিয়েছেন, বাবা-মা হারিয়েছেন তাদের তাদের জন্য এটা তৎকালীন সময়ে তাদের ওই হারানোর তাৎক্ষণিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে এটা দরকার ছিল হয়ত। কিন্তু বর্তমানে আমরা সবাই জানি যে এই ৫৩ বছর পরে কীভাবে শুধুমাত্র একটি দলের মানুষের সুবিধা প্রদানের একটা অস্ত্র হিসেবে এই কোটাব্যবস্থা ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে এই দুটোকে আমাদের আলাদা করতে হবে এবং আলাদা করে বৈষম্যবিরোধী অবস্থানটাকে আমাদের নিয়ে আসতে হবে। ওইখানটা থেকে আমি বারে বারে মনে করতে চাই যে বর্তমান পরিস্থিতিতে এই স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পূর্বে এবং পরেও আমি বৈষম্যবিরোধী অবস্থান থেকে বারবার চেনাতে চাই, চিনতে চাই নিজে এবং এটা নিয়ে কথা বলতে চাই। এটাই হচ্ছে আমার কাছে বর্তমান প্রেক্ষাপট। সেই সাথে আমি আরেকটা প্রসঙ্গে যাব পরে। 

দ্বিতীয় প্রসঙ্গটা ছিলো যে এই বর্তমান অবস্থায় আমার কমিউনিটির প্রতিক্রিয়াটা কী। এই প্রশ্নটা আমাকে অনেক ভাবিয়েছে, ভাবাচ্ছে যে আমি আসলে আমার কমিউনিটি বলতে কী বুঝি। কোনো আধিপত্যশীল বর্গ তার কমিউনিটিকে চিহ্নিত করতে পারে না। কারণ আধিপত্যশীল বর্গ হয়ে ওঠে ‘স্বাভাবিক’ কমিউনিটি। ফলে আমি দেখছি আমি বাংলাদেশি এইটুকু বললে আমার সবটা হয়ে যায়। এই যে আমি বাংলাদেশী হিসেবে আমাকে দেখছি এটা একটা আধিপত্যশীল কমিউনিটি। কারণ আমি বলতে পারছি আমি বাংলাদেশি। আমি মুসলিম, আমি নারী, সেটা একটা আলাদা প্রসঙ্গ। কিন্তু আমি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ। ফলে এই জায়গা থেকে আমার কমিউনিটি আমি নির্ধারণ করতে পারছি না তার একটা রাজনীতি আছে। 

আরেকটা প্রসঙ্গ হচ্ছে যে আমি সাম্প্রতিককালে প্যালেস্টাইনের প্রতি পুরো বিশ্বজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যে সংহতি দেখেছি সেই সংহতি আমাকে একটা জিনিস শিখিয়েছে। আমার মনে হয়েছে যে আমাদের কমিউনিটিকে একে অন্যের কথা বলতে হবে। আমি শুধু আমার সুবিধাপ্রাপ্ত অবস্থানকে চিহ্নিত করলেই হবে না। আমার সুবিধার কারণে যারা সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছে তাদেরকে আমার স্বপ্রণোদিত হয়ে জায়গা দিতে হবে, তাদের পাশে থাকতে হবে, তাদের পিছনে থাকতে হবে, তাদের সামনে না। তা না হলে আমরা আসলে একটা নতুন বাংলাদেশ গড়তে পারবো না। ফিলিস্তিনের মানুষের উপর যে গণহত্যা সেই গণহত্যার কথা যদি আমরা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে না পারতাম, অন্যেরা যারা ফিলিস্তিনি নন তাদের সাথে কিন্তু আমাদের এই শক্তিশালী একটা সংহতি তৈরি হতো না। এই সংহতি আমাকে শিখিয়েছে যে শেষমেশ আমাদেরকে কমিউনিটির বাইরে যেতে হবে। আমাদের সকলের একটা কথা হচ্ছে যে আমি এটা বলতে পারছি, কারণ আমি সুবিধাজনক একটা জায়গার মধ্যে আছি। কিন্তু আমি বলব যে সেখানে পৌঁছাতে গেলে আমাদের বৈষম্যকে চিনতে হবে, আমাদের সুবিধাপ্রাপ্ত অবস্থানকে চিনতে হবে এবং সুবিধাবঞ্চিত যারা তাদের পিছনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে শক্তি হয়ে।

আরেকটা জিনিস আমি বলতে চাচ্ছি। গত কিছুদিন ধরে যেরকমভাবে আমরা দেখছি যে বিভিন্ন সুবিধাবঞ্চিত যে সমস্ত জনগোষ্ঠী – এথনিক মাইনরিটি, এলজিবিটিআইকিউপ্লাস, আদিবাসী, হিন্দু, আহমেদিয়া সম্প্রদায়, এরা এক ধরনের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। কারা করছেন সেটা আমরা রাজনৈতিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি। কিন্তু এই যে ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতির মধ্যে আমরা সবাই আছি, আমরা সবাই দমবন্ধ করে অপেক্ষা করছি, কবে এই সহিংসতা বন্ধ হবে, কখন আমরা একটা মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থায় আসবো সেইটা জানি না। বর্তমানে যা চলছে তা হয়তবা আমাদের সবাইকে একটু ভয়ংকরভাবে বিভ্রান্ত করে রেখেছে। সেই জায়গা থেকে আমার আসলে সংহতি প্রদান ছাড়া আর কিছু বলার নেই। 

তারা: আমি একটু ছোট্ট করে নাসরিনের সাথে যুক্ত করতে চাই। কোটা প্রসঙ্গে নাসরিন যেটা বললেন, বাংলাদেশে যে মানসিকতা গড়ে উঠেছে যে কোটা একটি সুবিধা, সেটা কিন্তু হওয়ার কথা না। সামাজিক ন্যায্যতা  প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোটা একটি এক্সেসের (access) জায়গা। কিছু মানুষকে কোটার মাধ্যমে এক্সেসের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে যেন আপওয়ার্ড মোবিলিটির মাধ্যমে সামাজিক ন্যায্যতার  যে পরিকাঠামো সেটা নিশ্চিত হয়। আমরা যদি আমেরিকান ড্রিমের মতো করে বাংলাদেশি ড্রিমের কথা চিন্তা করি, বাংলাদেশি ড্রিম কী? সরকারি চাকরি হচ্ছে বাংলাদেশি ড্রিম, যার মাধ্যমে এক ধরনের আপওয়ার্ড মোবিলিটি তৈরি হয় সমাজের মধ্যে। এখানে তো সবার এক্সেস থাকতে হবে। কিছু মানুষের এক্সেস থাকবে, কিছু মানুষের এক্সেস থাকবে না, তা তো আর হবে না। তার বিপরীতে যে কথাটা বলা হচ্ছে কোটা আন্দোলনের স্লোগানের মধ্যে – কোটা না মেধা? এটা একটা অন্যতম স্লোগান ছিল। এই যে মেরিটোক্রেসি, মেধাকে সামনে নিয়ে আসা, এটা কেন? মেধা তো কোনো সুপার হিউম্যান কোয়ালিটি নয়। আমি তো জন্মগতভাবে মেধাবী হয়ে জন্মাই না। মেধা হলো এক্সপোজার। আপনি কী ধরনের সুবিধার প্রতি এক্সপোজড, আপনি কোন পরিবারে জন্ম নেন, আপনি কোন অঞ্চলে জন্ম নেন, আপনি কোন ধরনের স্কুলে পড়তে যান, আপনি কোন অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে জন্ম নেন, সেটার মাধ্যমে আপনার মেধার পরিকাঠামো তৈরি হয়। রাষ্ট্রব্যবস্থার দায়িত্ব হচ্ছে সমাজের সকল শ্রেণির, সকল ধরনের সকল সুবিধার নাগরিকের জন্য ন্যায্য এক্সেসের সুবিধা দেওয়া। সেখান থেকেই কোটা ব্যবস্থার উদ্ভব। এখন সেটাকে দুর্নীতির মাধ্যমে নষ্ট করা হয়েছে। ক্ষমতাকাঠামো যেভাবে বিভিন্ন সিভিল ইনস্টিটিউশনকে নষ্ট করেছে গত ৫৩ বছর যাবত ৷ তেমনভাবে জনমানুষে এই ধারণাটি তৈরি করা হয়েছে যে কোটা একটি সুবিধা। কোটা কখনোই কোনো সুবিধা নয়। কোটা একটি নায্যতার প্রশ্ন। মেধা কখনো কেউ জন্মগতভাবে পায় না। সেটার এক্সপোজার তৈরি করতে হয়। যারা বলছেন আমি মেধাবী, তাদেরও প্রশ্ন করা উচিত, আপনি কেন মেধাবী। আপনি কি মেধাবী এই কারণে যে আপনার আগের প্রজন্ম সে মেধার চর্চা করেছে সে চর্চার খানিকটা অংশ চামচে করে আপনার মুখেও তুলে দেওয়া হয়েছে? এই প্রশ্ন যতক্ষণ পর্যন্ত না রাস্তায় নেমে মানুষ করতে পারবে ততক্ষণ কোটা না মেধা এই প্রশ্ন তুলে সরকার পতন হবে, কিন্তু সমাজবদল কিন্তু হবে না।

ডালিয়া: এর জের ধরে আমি ছোট্ট করে আমার নিজের কমিউনিটি থেকে একটু যুক্ত করতে চাই, যেহেতু কোটা প্রসঙ্গে আলোচনাটা আসলো। পুরো আন্দোলনের শুরু থেকে আমি কী দেখেছি, আমার কমিউনিটি কীসের মধ্য দিয়ে গেছে এই ব্যাপারগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ এখানে। আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের কথা যখন আমরা বলতে যাব, এই আন্দোলনের শুরুটা কীভাবে হলো এটা কিন্তু আমাদের আলাপ করা উচিত আমি মনে করি। এই যে রাষ্ট্র সংস্কার এটা তো এসেছে কোটা সংস্কারের একটা মুভমেন্ট থেকে এবং এই কোটার যে প্রসঙ্গগুলো আপনারা আলাপ করলেন সেখান থেকে তো বোঝাই যাচ্ছে যে কোটা ব্যবস্থাটা আসলে কাদের জন্য দরকার, কী জন্য দরকার, কোন পরিস্থিতিতে দরকার, ‘সমতা’ অর্জনের জন্য আসলে কোটা কীভাবে কাজ করতে পারে। যখন কোটা আন্দোলনটা শুরু হলো ওখানে ব্যাপকভাবে এসেছে তারা বলল যে কোটা না, মেধা মেধা মেধা। আমার মনে হয়েছে যে আন্দোলনে এই অন্যান্য যে ন্যারেটিভগুলো উঠে আসা দরকার ছিল সেটা অনুপস্থিত ছিল। যখন কিনা মুক্তিযুদ্ধ কোটার সমালোচনা করা হচ্ছে এবং সেই কোটার বাতিলের বা সংস্কার করার কথা বলা হচ্ছে সেখানে কিন্তু অন্যান্য যে কোটা যাদের জন্য দরকার তাদের জন্য কিন্তু ওভাবে খুব একটা কথা শোনা যায়নি। আমি এমনও ভিডিও দেখেছি, এমনও কথা আমি শুনেছি যেখানে বলা হচ্ছে নারীর কোটা কেন দরকার, নারীরা তো আগের মতো আর পিছিয়ে নেই। কিন্তু এখানে যে একটা ইন্টারসেকশনাল লেন্সে দেখা দরকার ছিল যে কোন নারীর কথা আসলে বলা হচ্ছে। আরেকটু সূক্ষভাবে যে ভাবা দরকার ছিল এবং সেগুলো যে উঠে আসা দরকার। বলা হলো যে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’দের জন্য কোটা থাকতে পারে এবং যারা প্রতিবন্ধী তাদের জন্য কোটা থাকতে পারে। এই ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’র জন্যও যে কোটা কত পারসেন্ট হবে সেটা নিয়েও কিন্তু কোনো ধরনের দিকনির্দেশনা ছিল না। বরং এমনভাবে কথাগুলো উঠে এসেছে যে আমার কাছে মনে হয়েছে যে বেশ একটা প্যাট্রোনাইজিং টোনে ব্যাপারটা এসেছে। আমার মনে হয় যে ওই জায়গাটা থেকে আদিবাসী ছাত্র যারা ছিল তারাও এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা অনুভব করেছে। এই কোটা সংস্কারের দাবি তো শেষ পর্যন্ত একটা স্বৈরাচারী শাসকের পতনের আন্দোলনের দাবিতে চলে যায়। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসটা যদি একটু দেখি, সেই ২০১৮ সালে দেখা গেল যে আদিবাসীদের কোটাটা বাতিল করা হলো অন্যান্য কোটার সাথে এবং এ নিয়ে কেউ কথা বললো না। যারা তখন আন্দোলনে জড়িত ছিল তারা মনে হয়েছে একপ্রকার খুশি ছিল এই পুরো ১০০% মেধার উত্থানে। তারা কিন্তু অন্যান্য যারা সুবিধাবঞ্চিত তাদের কথা বলেছে বলে শোনা যায়নি। ওই জায়গাটা থেকে যারা আসলেই সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত তাদের মধ্যে একটা বঞ্চনাবোধ কিন্তু তৈরি হয়েছে। এই কোটা সংস্কার সম্প্রতি যেখানে আসলো তাতে দেখা গেল যেই বৈষম্যগুলো নিয়ে কথা আসা দরকার ছিলো, সেগুলো আসেনি। আমার মনে হয়েছে এই যে স্বৈরাচারী শাসকের পতন হলো, এই আন্দোলনের শুরু থেকে সেখানেও এক ধরনের কমিউনিকেশনের গ্যাপ রয়ে গেছে। এবং এটাই আসলে আশংকাজনক ব্যাপার যে যারা এটাকে প্রয়োজন মনে করেনি সেই তারাই শেষ পর্যন্ত সফল হলো বা তাদের চাওয়াটাই শেষ পর্যন্ত আমাদের ভবিষ্যতে প্রতিফলিত হবে কি না। এটা একটা শংকার ব্যাপার। 

নাসরিন: আমি যোগ করি এখানটাতে? আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। খুবই ধন্যবাদ তারা, আপনি যে কথাটা বলেছেন যে সামাজিক ন্যায্যতার বিষয়টি আরো বেশি করে ব্যাখ্যা করেছেন। আমি ওই কারণেই বলতে চাচ্ছি যে কোটাবিরোধী আন্দোলনের থেকে এটা শুরু হয়েছিল, কিন্তু কিন্তু এটার প্লাটফর্মের নাম হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। কেন হয়েছে? কারণ হচ্ছে কোটাকে একটা বৈষম্যমূলক অবস্থানে সরকার নিয়ে গিয়েছিল। এখন আমাদের ওই বৈষম্যবিরোধী প্লাটফর্মটাতেই আবার দাঁড়াতে হবে এবং বলতে হবে যে যেই বৈষম্য কোটাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, কোটার বিলুপ্তির কারণে যেন সেই বৈষম্য আবার নতুন করে সৃষ্টি না হয়। 

নাফিসা: অনেক ধন্যবাদ আপনাদের সবাইকে এবং খুব চমৎকার কিছু পয়েন্ট আপনারা তুলে ধরেছেন। আপনাদের কথা শুনতে শুনতে যেটা মনে হলো যে পার্থ চ্যাটার্জির একটা বিশাল এনালাইসিস ছিল – ন্যাশনালিস্ট রেজুলেশন অফ উইমেন্স কোয়েশ্চন। আমাদের যখন এ ধরনের গণ আন্দোলন হয়, তখন আপনি যদি এই প্রশ্নগুলো তোলেন যে আদিবাসীদের কোটা আগে ছিল ৫%, এখন কেন ১% বা এখন রিভাইজড রায় দেওয়া হলো যে (আদালতের রায়ের ভাষা ব্যবহার করে বলছি) ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ এবং প্রতিবন্ধীরা ১% কোটা পাবে। তো আগে যেমন নারী এবং শিশু সবসময় একটা ক্যাটাগরিতে রাখা হয়, নারী ও শিশু এক গ্রুপে এনে নারীকে ইনফ্যানটালাইজ করা হয়, আমরা কিন্তু এখানে খুব জেনেবুঝে অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবেই ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ এবং প্রতিবন্ধীদের একটা ক্যাটাগরিতে ফেলে দেখছি, এটা কিন্তু খুবই বৈষম্যমূলক, সমস্যাজনক এবং ভায়োলেন্ট অ্যাটিটিউড। খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে যে কোটা আন্দোলনের সময় আমি নিজে একটি নারীবাদী গ্রুপের সাথে কাজ করেছি যেখান থেকে আমরা একটা বক্তব্য দিতে চেষ্টা করছিলাম। সেখানে এই বিষয়গুলো আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করছিলাম। আমরা যখন মতামত চাচ্ছিলাম আমাদের সদস্যদের কাছে তখন অনেকে বলছিলেন এখন এটা নিয়ে কথা বলার সময় এটা না, এখন আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, আমাদেরকে সরকার পতন করতে হবে। তো এটাই কিন্তু এর আগে অনেক তাত্ত্বিক, অনেক অ্যাকটিভিস্ট কিন্তু বারবার বলেছে যে সমস্যা যেটা হয় অনেক সময় – গণ আন্দোলন যখন হয়, আমাদের তো সেখানে অংশগ্রহণ করতেই হবে, কিন্তু একইসাথে অনেকসময় দেখা যায় যে গণআন্দোলন কিন্তু অনেকখানি সংখ্যাগরিষ্ঠের মূল্যবোধ দিয়ে পরিচালিত হয়। যদি সমাজে সব মানুষ একসাথে স্বৈরাচারী হাসিনার বিরুদ্ধে কণ্ঠ না তুলত, হাসিনা কিন্তু পড়ত না। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় দেখেন মানুষজন বলছে তিন সপ্তাহে জেন-যি হাসিনাকে ফেলে দিলো। না, জেন-যি তিন সপ্তাহে হাসিনাকে ফেলে নাই। স্বৈরাচারী শাসনের নিপীড়নের ইতিহাসটা দেখেন। এটা কিন্তু বহু আগে থেকে শুরু হয়েছে। গত ১৫-১৬ বছর ধরে দেখবেন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট থেকে শুরু করে বিচার বহির্ভূত হত্যা, ছোট্ট একটা সমালোচনা করার কারণে জেলে ভরে দেওয়া ইত্যাদি দমন নিপীড়ন বহুদিন ধরে চলছে এবং অনেক মানুষ এটা নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু আমরা ভেবেছি যে আমাকে তো ধরে নাই, তাই আমি নিরাপদ। কিন্তু এটা ভাবতে ভাবতে একটা সময় দেখা গেল তার ঘরের যে স্টুডেন্ট সে সরকারের রোষানলের শিকার হচ্ছে। মানুষ একত্রিত হলো সেটা খুবই ভালো। কিন্তু এই ধরনের গণ আন্দোলনে দেখা যায় যে বড় ইস্যুর আড়ালে ছোট ইস্যু হারিয়ে যায়। ইলোরা চৌধুরী কোভিডের সময় বাংলাদেশে এবং আমেরিকায় কী হয়েছিল সেটা নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখেছিলেন এবং ওখানে তিনি বলেছিলেন যে সবাই সবসময় বলে যে “নট নাউ, নট নাউ, লেইটার, এখন এটা নিয়ে কথা বলব না, পরে কথা বলবো।” এই যে আপনারা যে কনসার্নগুলো তুলছেন, আমরা কিন্তু মূলধারার আন্দোলনে প্রায়ই দেখি যে মূল বিষয়গুলোর বাইরের কনসার্নগুলো পরে ভাবার জন্য তুলে রাখা হয়। সেই আলাপ পরে আর হয় না। আমার মনে হয় আমাদের এই কথাগুলো এখনই সামনে আনতে হবে। 

কোটা আন্দোলনে আমরা দেখেছি দুটো জিনিস সমান্তরালে চলছিল। একটা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা, যেটা আমাদের সমাজে বৈষম্য তৈরি করছিল। যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তাদের কথা আমরা বলছি না। তাদের প্রজন্মের বেশিরভাগই এখন জীবনের শেষ প্রান্তে। তাদের বাচ্চাদের সরকারি চাকরি বয়সও নেই। আমরা তাদের নাতিনাতনিদের কথা বলছি যাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি দেওয়াটা বাকিদের সাথে বৈষম্য। কিন্তু বাকি যে কোটাগুলো ছিল, যেমন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী/আদিবাসী কোটা,  নারী কোটা এগুলো কিন্তু বৈষম্য না। আমরা নাসরিনের আলোচনায় দেখি যে আমাদের যে কাঠামাগত বৈষম্য আছে তার খানিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে এগুলোই কিন্তু ছিলো। কিন্তু এই যে নুয়ান্সের জায়গাটা, যে একদিকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা এবং আরেকদিকে কিছু কোটা যেগুলো আসলেও এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর, যারা সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী তাদের প্রাপ্য, এটা আমাদের আন্দোলনের যে মেইনস্ট্রিম ন্যারেটিভ সেখানে মনে হয় বারবার হারিয়ে গেছে। প্রশ্নগুলো আমাদের তখনও তোলা প্রয়োজন ছিল, এখনো তোলার প্রয়োজন আছে এবং আমাদেরকে এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করে যেতে হবে। 

প্রশ্ন-২: খুব সংক্ষেপে যদি দুটো বিষয়ে চিন্তাভাবনা শেয়ার করেন – 

এক. আমাদের যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা করা হলো সেখানে বাইরে থেকে দেখতে গেলে অনেকেই কিন্তু খুশি যে এর আগে যদি আমাদের কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টে হয়ত একজন নারী, দুজন নারী, তিনজন নারী ছিলেন। এবার কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আমরা চারজন নারী পেয়েছি। এখানে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিত্ব আছে। এখানে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব আছে এবং আমি খুব সচেতনভাবেই ছাত্র শব্দটা ব্যবহার করছি। বিভিন্ন শ্রেণির, গোষ্ঠীর মানুষ এখানে আছেন। দেখতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে অনেক ডাইভার্স, বৈচিত্র্যময়। কিন্তু তারপরেও নিশ্চয়ই এটার ভেতরে নানা ধরনের পাওয়ার হায়ারারকি আছে। কারণ তাদের পলিটিক্স আলাদা। তারা সবাই একই পজিশন থেকে আসেন নাই। তাই জানতে চাইবো যে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে মেকআপ এটা নিয়ে আপনি কী ভাবছেন এবং এই সরকারের কাছে আপনি কী চাইবেন? আমাদের সামনে যে দিনগুলো আছে তার জন্য কোন জিনিসগুলো এই সরকারের প্রায়োরিটাইজ করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

তারা: আমার বাবাকে আমি ছোটবেলায় প্রশ্ন করতাম – সরকারটা কী? কারণ আমার ধারণা ছিল সরকার কোনো একটা ব্যক্তি যার কোনো চেহারা আছে। আমার বাবা চেষ্টা করলো আমাকে উত্তর দিতে। কিন্তু বুঝিয়ে বলতে পারলো না ঠিকমতো। এখন এই যে আমরা তত্ত্বাবধায়ক  সরকারের কথা বলি, সেই ঘটনাটা হয় বারবার – আমরা একই ধরনের ক্ষমতা কাঠামো দেখে আসছি। হয়ত নামগুলো বদলে বদলে যায়, ক্ষমতা কাঠামোর তৈরি হওয়ার পদ্ধতিগুলো বদলে বদলে যায়। আগে হয়ত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাকাঠামো তৈরি হতো। এখন আমাদের সংগ্রামী জনতা, মেহনতি ছাত্র-যুবজনতা তারা মিলে একটি ক্ষমতাকাঠামো তৈরি করলেন যেখানে তাদের পুরুষদের অংশগ্রহণ আছে, অন্য কারো অংশগ্রহণ নেই এবং সেখানে কিন্তু বেশিরভাগ যারা অংশগ্রহণ করছে তারা ব্যুরোক্রেট। এ ধরনের মানুষজনকে কিন্তু নিয়ে এসেছি আমরা। যদি এটা ছাত্রজনতার মুভমেন্ট হয়ে থাকে সেখানে প্রলেতারিয়েত এবং ছাত্রজনতার প্রতিনিধিরা কোথায়? সেখানে যিনি প্রধান, যিনি খুব সম্মানীয় এবং আমাদের সবার খুব বিশিষ্টজন, তিনি থেকে শুরু করে বাকি যে ছয়জন সদস্যদের কথা বলা হচ্ছে তাদেরকে বলা যেতে পারে কালচারাল এলিট, সোশ্যাল এলিট অথবা আমি যে শব্দটা ব্যবহার করতে চাই – তারা হচ্ছে এলিট ব্যুরোক্রেট। ব্যুরোক্রেসির ভিতরে, আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব স্বার্থ আছে, নিজস্ব অংশগ্রহণ আছে, পারিবারিকভাবে অংশগ্রহণ আছে, নানাক্ষেত্রে তার মাধ্যমে তারা ক্ষমতাকাঠামো বেয়ে আজকে এখানে এসেছেন। কাজেই আজকে যদি হাসিনার স্বৈরতন্ত্রকে আপনি প্রশ্ন করে থাকেন আন্দোলনের মাধ্যমে যে তিনি কীভাবে ক্ষমতায় এলেন বাপের নাম ব্যবহার করে, খালেদা কীভাবে ক্ষমতায় এলো স্বামীর নাম ব্যবহার করে, আমাদের এই যারা দায়িত্ব নিয়েছেন তাদেরকেও প্রশ্ন করতে হবে। তাদের অনেকের ভেতরেও তো সেই উত্তরাধিকারসূত্রে ক্ষমতা কাঠামোতে আরোহন করার ইতিহাস রয়েছে। একটু যদি আমরা রিসার্চ করি তাহলেই আমরা দেখতে পাবো ধর্মকে একটি অ্যানসেস্টেরিয়াল মেকানিজম হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আরোহন করার পদ্ধতি রয়েছে কার কার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেটি তৈরি করা হয়েছে তার যে স্টেকহোল্ডারদের রাখা হয়েছে সেই স্টেকহোল্ডারদের জন্য প্রধান প্রশ্ন আমার – সেখানে কেমন করে একজন ব্যক্তি থাকে, যার প্রচণ্ড ভীতিকর ইতিহাস রয়েছে মুসলিম ফান্ডামেন্টালিস্ট হিসেবে? তাকে মুসলিম স্কলার বলা হচ্ছে। পণ্ডিত শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। পত্রিকায় লেখা হচ্ছে উনি একজন ইসলামিক পণ্ডিত। আমি বলছি ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিস্ট হিসেবে যার এই ট্রাজেক্টরি রয়েছে সে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার, তাকে একজন মেইন স্টেকহোল্ডার হিসেবে রাখার যৌক্তিকতা কী? তাকে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে দিলাম। যে সরকার কাঠামো তৈরি হলো এবং তার মধ্যে যে ধরনের নারী প্রতিনিধিদের অবস্থান আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটা নিয়ে আমাদের প্রগতিশীল, একটু প্রবীণ নারীবাদীরা খুব সুখবোধ করলেন। কারণ এরা তাদের অনেকেরই বন্ধু বা এক ধরনের গোত্রের সদস্য। আমার তো যথেষ্ট সংশয় রয়েছে তারা কী ধরনের নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে আসতে পারেন। কারণ তাদেরকে আমি একজন কালচারাল এলিট হিসেবেই গণ্য করবো। এর বাইরে অন্য কিছু হিসেবে গণ্য করার মতো ক্ষমতা বা তথ্য এই মুহূর্তে আমার হাতের কাছে নাই। 

আমার এতগুলো কথার সারাংশ যেটা দাঁড়ায়, আমার কথার যে উদ্দেশ্য সেটা হলো যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে জরুরি অবস্থার ভিত্তিতে। তাদেরকে অনেকক্ষেত্রে আমার মনে হচ্ছে নতুন বোতলে পুরনো মদ। তারা যে প্রোপাগান্ডা মেকানিজম তৈরি করছেন গত কয়দিনে, আমি দেখেছি সব ন্যারেটিভকে আপসাইড ডাউন করে দেওয়া। গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে কোনো সিভিল ইনস্টিটিউশন তৈরি হয় নাই। নাসরিন কাজ করে এসেছেন একটা সিভিল ইনস্টিটিউশনে। ১০ বছর একটা ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেছেন। যদি শক্তিশালী সিভিল ইনস্টিটিউশন তৈরি হতো তাহলে কোটা কী, সামাজিক ইকুইটি কী, সামাজিক ন্যায্যতার প্রশ্ন কী সেগুলো নিয়ে এত বিশ্লেষণ যা মানুষ বুঝছে না সেটা নিয়ে কথা বলতে হতো না। বৈষম্য, কোটা, সামাজিক ন্যায্যতার প্রশ্নে বোঝাপড়াগুলো তো সিভিল ইনস্টিটিউশনগুলোই তৈরি করবে। সিভিল ইনস্টিটিউশন নেই বলে বা তৈরি হতে পারেনি বলে সেই জায়গাগুলো তৈরি হয়নি। এখন আবার যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিচ্ছেন তারা সিভিল ইনস্টিটিউশনগুলোকে আপসাইড ডাউন করে ফেলছেন। এক ধরনের মতবাদ তৈরি করা হচ্ছে যে আগে যা ছিল সবকিছু খারাপ, নতুন করে যা তৈরি করব সবকিছু ভালো – যা কিছু নতুন তা সব ভালো, যা কিছু পুরনো সব খারাপ। শেখ মুজিবের ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়াও সেই মতবাদের অংশ। এই মানসিকতা নিয়ে কোনো নতুন ধরনের আলোচনার ক্ষেত্র আসলে কি তৈরি হতে পারে কি না সেটা সকলের ভেবে দেখা দরকার। যদি ভালো ক্ষেত্র তৈরি করতে হয়, আমাদের বুঝতে হবে সবকিছুর মধ্যে গ্রে এরিয়া থাকে। ভালো যেমন থাকে, খারাপও থাকে। স্বৈরাচারী সরকারের রেজিমের কারণে এর আগেও আমাদের সেনাশাসন ছিল। তার ফলে যে ইনস্টিটিউশনগুলো তৈরি করা হয়েছে তার সবকিছু খারাপ, তার সবাইকে বাদ দিয়ে দেওয়া, সবাইকে নামিয়ে দেওয়া, কিংবা ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার লাল করা না থাকলে আন্দোলনবিরোধী ধরে নেওয়া, যদি কেউ কোনোভাবে আওয়ামীলীগের সঙ্গে দুটো মিছিলে গিয়ে থাকে সে খারাপ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবে, এই যে বাইনারি সামাজিক মানসিকতা সেটা তো হাসিনা সরকারের থেকে খুব বেশি আলাদা বলে মনে হচ্ছে না আমার কাছে এই মুহূর্তে। এবং সেই বাইনারি সেন্টিমেন্ট আমরা মাইনরিটি ইস্যুর ভেতরেও নিয়ে আসি। এলজিবিটিকিউআইপ্লাস, কিংবা তৃতীয় লিঙ্গের কথা যদি বলি – তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরকে প্রতিবন্ধীদের সাথে একটা ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়েছে। কারণ আমরা তো মনে করি ট্রান্সজেন্ডাররা প্রতিবন্ধী। বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার পটভূমিতে যেই ‘যুক্তি’ বারবার দেখানো হয় তা হলো জন্মগতভাবে যিনি ‘তৃতীয় লিঙ্গের’ মানুষ তার তো শরীরের উপর এজেন্সি নাই। 

আমি একজন ট্রান্সজেন্ডার মানুষ। আমাকে বোঝানো হচ্ছে আমার শরীরের উপর যদি এজেন্সি থেকে থাকে, আমি যদি আমার নারী শরীরের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার চর্চা করি, আমি আমি ভালো নই, আমি ভালো ট্রান্সজেন্ডার নই। আমি যদি ইন্টারসেক্স হয়ে জন্মাই তাহলে আমাকে ‘লিঙ্গীয় প্রতিবন্ধী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। তার মনে আমার শরীরের এর উপর আমার এজেন্সি নাই। কোনো এক অসীম ক্ষমতাধর সৃষ্টিকর্তার এজেন্সি আছে আমার শরীরের উপর। তার মানে আমি অসহায়। আমাকে একটি কোটা দেওয়া হোক, আমাকে একটা সামাজিক জায়গা দেওয়া হোক এবং এই যে ‘থার্ড জেন্ডার’ নামে একটি অতি কুৎসিত শব্দ তৈরি করা হয়েছে আমাদের সমাজে, এর সমাধান কী? এই শব্দের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ম্যান্ডেট তৈরি করেছে আমাদের স্টেকহোল্ডাররা। আমাদের কমিউনিটির মানুষরা করেছে, হাসিনা সরকার করেছে। সবাই মিলে করেছে। এখন অনেক তো অভিযোগ জানিয়ে গেলাম। আশা রাখি এই যে যারা এলিট ব্যুরোক্রেট, যারা ক্ষমতা নিলেন আগামী কিছুদিনের জন্য তাদের একজন বা দুইজনও টার্মিনোলজিগুলোকে ঠিক করার দিকে একটু ফোকাস করবেন। অন্তত আমি আমার ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির জন্য বলতে পারি যে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সঙ্গে জেন্ডার এক্সপার্টদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একটা ট্রান্সজেন্ডার পারসন সিকিউরিটি অ্যাক্ট বিল তৈরি করার প্রক্রিয়া চলছে অনেকদিন ধরে। পাঠ্যবইতে ট্রান্সজেন্ডারদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে অনেক ধরনের বাজে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। ‘শরিফ-শরিফা’ ইস্যু থেকে অনেক কিছু উঠে এসেছে, আমরা জানি। এই আন্দোলনের মুখপাত্র যারা, তাদের কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়াতে সেইসময় অনেক বিপদজনক মন্তব্য, বিপদজনক এনালাইসিস প্রকাশ করেছেন আমাদের সামনে। তার ফলে কমিউনিটির মানুষ হিসেবে আমার তো আস্থার একটু ঘাটতি রয়েই গেছে। যিনি মাত্র তিন মাস আগে আমার কমিউনিটি সম্পর্কে কনস্পিরেসি প্রোপাগান্ডা চালিয়েছেন ফেসবুকে, তাকে আমি কি আদৌ বিশ্বাস করতে পারি? তার প্রতিনিধিদের সরকার কাঠামোর মধ্যে যে তিনি আমাদের জন্য ভালো হয়, সুশীল হয়, এমন কোনোকিছু করবেন সেটা আমি ভাবতে পারছি না। 

আরেকটা কথা হলো আমি মনে করি শব্দগুলোকে উচ্চারণ করা উচিত। মুক্তিযোদ্ধা কোটা যেমন উচ্চারণ করা উচিত, তেমনি এলজিবিটিকিউআইপ্লাস, ট্রান্স এবং নন বাইনারি, সমকামী শব্দগুলোও উচ্চারণ করতে শিখতে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স ৫৩ বছর হতে চললো। আমরা কবে আর এই শব্দগুলো উচ্চারণ করব? কতদিন আমাকে বলতে হবে আমি থার্ড জেন্ডার, স্ট্রাটেজিক্যালি আমি হচ্ছি মাইনরিটি, আমি যৌন সংখ্যালঘু কিংবা বৈচিত্রময় জনগোষ্ঠী? আমি তো কোনো বিচিত্র ম্যাগাজিন প্রোগ্রাম না। আমি তো একটা জলজ্যান্ত মানুষ। সক্ষম অক্ষম নানা ধরনের মানুষ আমরা। তাহলে আমাকে কেন নিজেকে সেন্সর করে এমন সব শব্দ বেছে নিতে হবে আমার পরিচয় প্রকাশ্যের জন্য যেটা রাষ্ট্রকাঠামোর ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে যারা আছে তাদেরকে অতটা আঘাত করবে না? এই রাষ্ট্রকাঠামোর ক্ষমতাকাণ্ড সিসপ্যাট্রিয়ার্কি। তাদেরকে আঘাত করবে না এমন সব শব্দ আমাকে বেছে নেওয়ার জন্য আগেও জোর দেওয়া হয়েছে। এখনো জোর দেওয়া হয়েছে। ইউনূস যদি একজন প্রগতিশীল মানুষ হয়ে থাকেন, বিশ্ববরেণ্য মানুষ হয়ে থাকেন, তার ক্যাবিনেটে যারা আছেন তারা যদি সামাজিকভাবে প্রগতিশীল মানুষ হয়ে থাকেন, আমি আশা করব এই সাধারণ যুক্তি বুঝে নিবেন যে আমাদের নিজেদের শব্দের পরিচয়টা কী হবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমাকে দিতে হবে। আমার সিদ্ধান্ত আপনি বা আপনার সরকার কাঠামো করে দেবে না। আমি তৃতীয় লিঙ্গ নাকি ট্রান্সজেন্ডার, হিজড়া ভালো নাকি ট্রান্সজেন্ডার ভালো এই ধরনের বিতর্কের মধ্যে আমাকে নিয়ে যাবেন না। সেই বিতর্ক আমার জন্য ভালো না, আপনার জন্য ভালো না। কারণ আপনি যখন এই ভালো না খারাপ ওই বাইনারি কনভার্সেশন তৈরি করছেন তখন আমার আইডেন্টিটি যেমন হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে, তেমনি আপনি যে রাষ্ট্রীয় অস্থিতিশীলতার ভয় পান সেটাও বাড়বে। আপনি যদি ভয় পান যে হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডার, এলজিবিটিকে, সমকামী মানুষদের কোনোভাবে যদি শব্দের মাধ্যমে আমার রাষ্ট্রকাঠামোতে, আমার আলাপের জায়গায় প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়, তাহলে আমার রাষ্ট্র অস্থিতিশীল হয়ে যাবে, আপনার রাষ্ট্র অনেক বেশি অস্থিতিশীল হবে যখন আমাকে আপনি প্রবেশ করতে দিবেন না। এটা আপনার শেখার আছে হাসিনা রেজিমের পতনের ভেতর দিয়ে। হাসিনা তো এক্সেস দেন নাই। নিজের মতো করে বলেছেন কোন শব্দে কথা হবে, কোন কথা বলা যাবে, কোন কথা বলা যাবে না। কাজেই সেখান থেকে একটু দয়া করে শেখেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নেতারাও শেখেন, ইউনূসও শেখেন, অন্যান্য সরকারও শেখেন। আপনি যদি আমাকে আমার মতো করে পরিচিত হতে আমার আমার সক্ষমতা নিয়ে পরিচিত হতে জায়গা না দেন, শুধু টোকেনাইজ করেন, লোক দেখানো প্রতিনিধি তৈরি করেন যারা “হ্যাঁ স্যার”, “যা বলছেন, ঠিক স্যার”, “আপনার কথাই ভালো, স্যার” এই ধরনের প্রতিনিধি তৈরি করে আপনি নিজেকে হয়ত ফিট করতে পারবেন এই ভেবে যে খুব ভালো করছেন, সমাজে বিশাল প্রগতি হয়ে যাচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নতি হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আদৌ আজ থেকে তিন বছর, পাঁচ বছর, বিশ বছর পর আরো একটি সংকটের সম্মুখীন বাংলাদেশের মানুষ হবে। 

শেষ যে কথাটি বলতে চাই – আমাদের বাংলাদেশের বাঙালি মুসলিমের এক ধরনের ইউটোপিয়া আছে এই মুহূর্তে। তার মধ্যে আমাদের সিভিল সোসাইটির অংশ আছে, ছাত্র মেহনতি জনতা আছে, যারা আমাদের ইউনিভার্সিটির শিক্ষক তারা আছে। এই বাঙালি মুসলিম ইউটোপিয়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কোনো কিছু পরে হয় না। সবকিছুকে একসঙ্গে হতে হয়। সব সামাজিক আলাপ তৈরি করার জায়গা করে দিতে হয় মানুষকে, যেভাবে নাসরিন বিশ্লেষণ করলেন। কাজেই যারা সব ভালো ভালো খবর নিয়ে ব্যস্ত, যারা নতুন দেশের স্বপ্ন দেখছেন, তারাও একটু বলেন যে ইউটোপিয়ার ভেতরে আর বাঁচা যাবে না। আমাদের দেশে অনেক অসঙ্গতি আছে, অনেক কিছু ঠিক হয় নাই, আমরা ঠিক করার চেষ্টা করছি। এবং সেই ইউটিউোপিয়া থেকে আমাদের সবচেয়ে বেশি জরুরি মধ্যবিত্তের বের হয়ে আসা। আপনি যদি মনে করে থাকেন আমাকে স্বীকার না করে আপনি ভালো থাকবেন, তা কিন্তু পারবেন না। আমার মধ্যে যে অস্থিতশীলতা তৈরি হবে সেটা আপনার মধ্যেও যাবে। আপনার যে ইউটোপিয়া যে মেধার ভিত্তিতে  সবাইকে জায়গা করে দিলে সবাই খুব ভালো থাকবে সেটা নিয়ে পড়ে থাকলে এরপ শ্রেণিগত সমস্যা তৈরি হবে যে সমস্যায় বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই অনেক মানুষ ভুগছে দিনের পর দিন। তাই এলিট ব্যুরোক্রেসি না করে একটু গণমানুষের কথা ভাবেন, গণমানুষ কীভাবে কথা বলতে চায়, কী করে সমাজে বাঁচতে চায় সেটার কথা ভাবেন। তা না হলে শুধু একজন নোবেল প্রাইজ লরিয়েট দিয়ে দেশ চালালে যে দেশ একবারে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে যাবে সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় রয়ে গেছে।

ডালিয়া: ধন্যবাদ, তারা। খুব সুন্দর করে অনেক কিছু তুলে ধরেছেন। আমি আমার আদিবাসী পরিচয়ের জায়গা থেকে তারার সাথে একমত। আমার পরিচয় কী হবে সেটা ঠিক করার অধিকার যেন আমাকে দেয়া হয়, আমাকে যেন সংখ্যাগরিষ্ঠ এসে নির্ধারণ না করে দেয় যে আমি কী হবো, আমি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হবো নাকি আমি উপজাতি হবো, এবং সেই অনুযায়ী আমি হাতে কী পাবো কিংবা কী পাবো না সেটা যেন আমাকে ঠিক করে দেয়া না হয়। এই ধরনের ভবিষ্যৎ আমি চাই না। এবং এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেটা আসলো এটা নিয়েও ফেসবুকে বিদগ্ধজনদের দেখতে পাচ্ছি বেশ স্বস্তিবোধ করছেন। তারা মনে করছেন যে নানান দলের এখানে প্রতিফলন আসছে। কিন্তু তারার মতো করে আমিও একরকম ক্রিটিক্যাল থাকতে চাই। যেই ১৬ জনকে আমরা দেখতে পাচ্ছি এই বডির মধ্যে। কিন্তু আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেয়ে এখানে সদস্যসংখ্যা বেশি বলে আমার মনে হয় না যে এখানে খুশি হবার কিছু আছে। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যদি আমরা বিবেচনায় নেই, যারা এই সুবিধাজনক জায়গাগুলোতে থাকেন তারা দেখা যায় শেষ পর্যন্ত পপুলিস্ট পলিটিক্সের ওই জায়গাটাতে ওরা কাজ করেন। তো এই ইন্টারিম গভর্নমেন্টের কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে এটা যেন শেষ পর্যন্ত জনতুষ্টিবাদী কোনো সরকারব্যবস্থা যাতে না হয়। কারণ এখানে জনগণকে আমি কোনো নির্দিষ্ট একটামাত্র ফ্রেমে দেখতে পারবো না। এখানে নানান পরিচয়ের মানুষ আছেন – ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গভেদে এখানে নানান পরিচয়ের মানুষ আছেন। সেই মানুষগুলোর জন্য একটা ইনক্লুসিভ ফিউচার আমি দেখতে চাই। এখানে আমি যদি আদিবাসীদের কথা বলি, এখানকার যে একটা পলিটিক্স সেটা বাংলাদেশের ৭১ সালের স্বাধীনতারও আগে থেকে চলে আসছে। এইখানে আদিবাসীরা যে পলিটিক্সের শিকার হয়ে আসছে সবসময় এবং এখানকার যে রাজনৈতিক বাস্তবতা সেটাকে আমি আরেকটু মনে করিয়ে দিতে চাই। মেজরিটেরিয়ানদের মধ্যে যেই ধরনের মাইনরিটাইজেশনের এক ধরনের প্রক্রিয়া আমি দেখতে পাই, আদিবাসীদেরকে সেইটাও আমি আরেকটু আরেকবার মনে করিইয়ে দিতে চাই। এখানে আমার বাবার একটা কথা বলতে চাই। আমার বাবাকে সম্প্রতি জিজ্ঞেস করা হলো যে “আচ্ছা, এখন তো হাসিনা চলে গেল। কী মনে হয় তোমার?” 

তখন সে বলেছে, “বাঙালি হয় বিএনপি নাহয় তারা আওয়ামীলীগ।” 

তার এই কথাটা থেকে বুঝা যায় আসলে আদিবাসীদের জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটা কী। আমার মনে হয় যে তার এই কথাটায় কিন্তু খুবই স্পষ্ট যে আওয়ামীলীগ হোক, বিএনপি হোক, যেই সরকারই হোক না কেন, আদিবাসীর ভাগ্য কখনো পরিবর্তন হয় না। সবসময় আদিবাসীরা রাজনৈতিক সংকটের ঝুঁকি বয়ে এসছে এবং সেটার জন্য তাদের ভাগ্য ওভাবেই পরিবর্তিত হচ্ছে। এই যে আমি দেখতে পাচ্ছি ফেসবুকে এক ধরনের আলাপ চলছিল যে হাসিনা চলে যাওয়ার পর ইন্টারিম গভর্নমেন্টে কি আদিবাসীদের কোনো প্রতিনিধিত্ব রাখা হবে কি না। তো আমরা  দেখলাম চূড়ান্ত যে তালিকা এলো সেখানে সুপ্রদীপ চাকমা আছেন। কিন্তু এখানেও অনেক ধরনের আশংকা দেখা যাচ্ছে। কারণ যিনি এসেছেন তিনি আসলে কতটা আদিবাসীদের জন্য কাজ করতে পারবেন আমরা জানি না। কারণ আদিবাসীদের প্রেক্ষাপটে কাজ করাটা কিন্তু অত্যন্ত জটিল। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পটভূমির দিকে তাকালে দেখবেন এটা অত্যন্ত মিলিটারাইজড একটা জোন। হাসিনার পতন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এখানকার যে মিলিটারাইজেশনের প্রক্রিয়া সেটা তো বন্ধ হয় নাই বা চলে যায় নাই। এই মিলিটারাইজেশনের তো এক ধরনের একটা হেজিমোনি আগে থেকেই আছেই সংখ্যাগরিষ্ঠের মননে। ওই জায়গাটা থেকে এই পার্বত্য চট্টগ্রামের পটভূমিতে আদিবাসীদের দরকার বুঝে কাজ করা, যেটা আসলেই আদিবাসীদের জন্য কাজ করবে, আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা করে, তাদের সংকটকে শনাক্ত করতে পারবে, এটা পারবেন কিনা সেটা নিয়ে খুব একটা স্বস্তির অবকাশ আমি দেখছি না। স্বস্তি যে কাজ করছে না সেটাকে কিন্তু নেতিবাচক হিসেবে দেখা উচিত হবে না যদি এই ইন্টারিম গভর্নমেন্ট আসলেই কাজ করতে চায় মানুষের জন্য। বরং এই যে যেগুলো নেতিবাচক কথাগুলো আসছে সেগুলোকে বরং আরো বেশি আমলে নেওয়া উচিত। কোন সীমাবদ্ধতার কারণে এই ধরনের মন্তব্যগুলো আসছে সেগুলো ভাবা উচিত। আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে যে রিপ্রেজেন্টেশন এসেছে, কিন্তু পলিটিক্স ছাড়া রিপ্রেজেন্টেশন এটা তো স্রেফ একটা টোকেন। যিনি এসেছেন আদিবাসীদের জন্য রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে তার কাছে প্রত্যাশা থাকবে যে তিনি যেন আদিবাসীদের যে সংকটগুলো আছে সেগুলো বুঝবেন। এখানে আরেকটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ – পাহাড় আর সমতলের সংকটের ভিন্নতা। সমতলেও আদিবাসী আছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী এবং সমতলের আদিবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপট কিন্তু ভিন্ন। ওই জায়গাটা থেকে তাদের বঞ্চনার যে প্রক্রিয়াগুলো, সেগুলোও কিন্তু ভিন্ন। তো ওই জিনিসগুলোকে আলাদা আলাদা করে শনাক্ত করে কাজ করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বলে তাকে আমি পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ই দেখবেন, কিন্তু সমতলের আদিবাসীদের সমস্যাগুলো দেখবেন না, যদি ব্যাপারটা এরকম হয় তাহলে বৈষম্যহীনতার কথা বলে আদিবাসীদের মধ্যে এটা আরো বড় বৈষম্য তৈরি করবে। আমরা তা চাই না। আমরা এমনিতেই বৈষম্যের মধ্যে আছি। আমরা চাই এটা থেকে উত্তরণ ঘটাতে। আমরা চাই না যে আমাদের মধ্যে ইতোমধ্যে যে বৈষম্যগুলো তৈরি করা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে সেগুলো সামনে গিয়ে আরো গভীর হয়ে ওঠুক। ইন্টারিম গভর্মেন্টের কাছে এটা একটা চাওয়া। আমাদের আরেকটা সংকটের জায়গা হচ্ছে এই ইন্টারিম গভর্মেন্ট নতুন একটা ফর্ম, কত বছরের জন্য আসছে, তাদের কাজের পরিসর কী, কাজগুলো কী কী, ম্যান্ডেটগুলো কী আমরা এখনো জানি না। আমরা আমাদের দাবিগুলো নিয়ে কথা বলছি। আমরা কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছি না যে তারা আসলে কতটুকু কাজ করতে পারবে। হ্যাঁ, আমরা একটা গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলছি। কিন্তু সেটা নিশ্চিত করতে গিয়ে এটা শেষ পর্যন্ত ওই জনতুষ্টিবাদী সরকারে পর্যবসিত হবে কি না এই প্রশ্ন আমি রেখে যাবো। 

সবশেষে বলতে চাই যে এই যে আমাকে আজকে বারবার আদিবাসীদের সমস্যার কথাগুলো বলতে হচ্ছে, আমাকে আমার বঞ্চনার কথাগুলো বলতে হচ্ছে, মাঝেমধ্যে মনে হয় যে আমি তো আসলেই শুধু ভিকটিম। আমি তো শুধু ভিকটিম হিসেবে পরিচিত হতে চাই না। আমি তো চাই আমার কাজের জন্য পরিচিত হতে। আমার কাজের জন্য যেন আমি পরিচিত হতে পারি, আমার সাথে আরো নানানরকমের যে আদিবাসী, নারী-পুরুষসহ এখানে লিঙ্গ এবং ধর্মীয় যে পরিচয়গত ভিন্নতাগুলো আছে সেইসব মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে আমি বলতে চাই যে আমরা আমাদের কাজের জন্য পরিচিত হতে চাই। আমরা কোনো টোকেন হিসেবে পরিচিত হতে চাই না। আমরা ভিকটিম হিসেবে থাকতে চাই না। আমাদের কোনো সেভিয়র, কোনো রক্ষাকর্তা দরকার নাই। আমাদেরকে নিজের কাজটা করতে দেয়া হোক। তো ওই সুযোগটা যেন এই ইন্টারিম গভর্নমেন্ট তৈরি করে এই প্রত্যাশা থাকলো এবং ডিমান্ডের চেয়ে বরং আমাদের প্রশ্নগুলো যেন উঠে আসে, সেটাই চাই।

নাসরিন: তারা এবং ডালিয়া অনেককিছুই বলে ফেলেছেন। আমি খুব সংক্ষেপে বলতে চেষ্টা করব, যেহেতু আমাদের সময় বেশি নেই। এক হচ্ছে যে এই ইন্টারিম গভর্মেন্ট তৈরিই হয়েছে একটা জরুরি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে, ডকট্রিন অফ নেসেসিটি থেকে। এটা একটা সামাজিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে এবং এটাকে ক্রান্তিকালীন একটা ব্যবস্থা হিসেবে আমি দেখছি। এই ক্রান্তিকালে যে ব্যবস্থাটা তৈরি হয়েছে সেই ব্যবস্থাতে খুশি হবার কিছু আমি দেখি না। কারণ হচ্ছে যদি প্রশ্ন করেন যে এটা রিপ্রেজেন্টেটিভ কি না, আমি বলব এটা অবশ্যই রিপ্রেজেন্টেটিভ না। বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিক যে চিত্র সেই ডেমোগ্রাফিক পার্সেন্টেজ যদি যেকোনো সভাতে, যেকোনো কমিউনিটিতে বা সরকারে প্রতিফলিত না হয়, আমরা বলতে পারি যে এটা রিপ্রেজেন্টেটিভ না। এটা বলার জন্য খুব বেশিদূর যেতে হয় না। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে তাদের রাজনীতি কী? যেমন আমাদের যে রিপ্রেজেন্টেটিভ দরকার, এটা যে নাই সেটা আমি বলে দিয়েছি। কারণ বুঝতেই পারছি যে এটা নাই। যেটুকু আছে সেটুকুতে হয়ত আমরা খুশি হতে পারি আপাতত মন্দের ভালো অর্থে। আমরা ‘মন্দের ভালো’ নিয়ে অনেক অনেক বছর ছিলাম। এখন আমাদের যে ক্রান্তিকালে অনেক রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে আমরা আরেকটা মন্দের ভালো পেয়েছি। রক্তক্ষরণ যে আরো বেশি হয়নি এজন্য আমরা খুশি। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাওয়ার আগেই আমরা কিছুটা হলেও স্থিতাবস্থায় পৌঁছাতে পেরেছি, এটা একটা ভালো খবর। কিন্তু সেটা তো কেবল একটা জরুরি অবস্থায় ভালো খবর। এই ভালো খবরের উপর বেশি ভরসা করে লাভ নাই। যে সরকারের পতনের জন্য এতকিছু হলো সেটা ছিল এটা ফ্যাসিবাদী সরকার। একটা ফ্যাসিবাদী সরকার বা একটা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কী করে? একটা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা সমস্ত বৈচিত্র, সমস্ত ভিন্নতার কণ্ঠরোধ করে ফেলে। সেই জায়গা থেকে যদি আমরা নতুন কিছু তৈরি করতে চাই আমাদেরকে ফ্যাসিবাদীর ব্যবস্থার উল্টোটাই করতে হবে – সমস্ত ভিন্নতাকে জায়গা দেবার এবং সমালোচনা নেবার সক্ষমতা তৈরি করার জন্য এটাকে মূল ভিত্তি হিসেবে দেখতে চাই আমি। যদি বিরোধিতা থেকে আমরা সরকার পতন করে থাকি, তাহলে আমাদের লক্ষ্য হবে সমালোচনা নিয়ে ভিন্নতার স্বীকৃতি দিয়ে ভিন্নতাকে সম্মান দেখানো এবং এইক্ষেত্রে আমি মনে করি আমাদের সহনশীল হওয়া জরুরি। আমাদের এই দীর্ঘ ৫২-৫৩ বছরের বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং তারও পূর্বে ঔপনিবেশিক ইতিহাস থেকে আমাদের যে বাঙালি বনাম মুসলিমের যে বাইনারি তৈরি করে দেয়া হয়েছে, সমস্ত ভিন্নতাকে গ্রাস করে একদম হোমোজেনাইজ করে ফেলা হয়েছে, যে জুজুর ভয় দেখিয়ে পরস্পরকে ঘৃণা করার একটা রাজনৈতিক বাহাস তৈরি করা হয়েছে সেই ঘৃণার মধ্যে তো আমরা থাকি না। জীবন তো আমরা যাপন করি। কিন্তু যে একটা রাজনৈতিক বাহাস বা রাজনৈতিক ডিসকোর্স তৈরি হয়েছে আমার মনে হয় সেই জায়গা থেকে আমাদের প্রত্যেকেরই এবং একইভাবে সরকারের দায়িত্ব আছে ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা তৈরি করার। এই জায়গা থেকে কাজ শুরু করতে পারাটা খুবই খুবই জরুরি। অনেকে কথা বলবেন। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি – একাউন্টেবিলিটি তৈরি করা। তাদের মানুষের প্রশ্নের সমালোচনা শোনা, প্রশ্নের জবাব দিতে থাকা এবং তাদের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী না হয়ে ওঠা, এইটুকুই থাকবে আমার একদম ভিত্তিমূলের দাবি এবং বাকি দাবিগুলো আসবে এরপরে। আমার একদম ফান্ডামেন্টাল দাবি তাদের কাছে যে আপনারা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যাবেন না, আপনারা সিভিল সোসাইটি নিয়ে একটা বহুকেন্দ্রিক ক্ষমতার একটা আবহ তৈরি করেন যেখানে সবাই সবার কথা শুনবে এবং সকলের মতামত নিতে প্রস্তুত থাকবে, পরস্পরের মতামতের প্রতি সহনশীল হবে। এইটুকুই আমার একদম ভিত্তিমূলে চাওয়া। বাকি অনেককিছু আছে যা অনেকেই বলবে। আমি আর সেখানে যাব না।

প্রশ্ন-৩: অনেক ধন্যবাদ। আমরা এবার আমাদের এখানে যারা অংশ নিচ্ছেন তাদের সাথে আলোচনায় চলে যেতে পারি। বেশ কয়েকজন বেশ কয়েকটা ভালো প্রশ্ন করেছেন। আমি প্রশ্নগুলো প্যানেলকে জিজ্ঞেস করছি। একটা প্রশ্ন এসেছে যে আমাদের ইন্টারিম গভর্নমেন্টের ডিউরেশন নিয়ে। এ প্রসঙ্গে আমি শাহদীন মালিকের রিসেন্ট একটা কমেন্ট বলতে চাই। উনি এরকম একটা কথা বলেছেন যে এই মুহূর্তে যদি নির্বাচন দেওয়া হয় বা খুব দ্রুত যদি নির্বাচন দেওয়া হয় তাহলে বিএনপি ল্যান্ডস্লাইড ভিক্টরি নিয়ে জিতবে এবং তারা মূলত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবে। তারা সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে, তারা যেকোনোকিছু অদলবদল করতে পারে। এখন এই একই জিনিস কিন্তু যখন প্রথম ক্ষমতায় এসেছিল তখন হয়েছিল। তো আমরা কি একটা রাজনৈতিক দলকে এত ক্ষমতা দিতে চাই কি না? কারণ আমরা একটা স্বৈরাচারকে উৎখাত করেছি এবং এখনই যদি নির্বাচন হয় তাহলে হয়ত আরেকটা স্বৈরাচারী সরকার তৈরি হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়ে যেতে পারে। তো আপনাদের কি কোনো চিন্তা আছে এটা নিয়ে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ আসলে কত হওয়া উচিত? 

নাসরিন: আমার মনে হয় যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক, যারা কিনা পুরোটা সময় ধরে আন্দোলনের সময় একেবারে মাঠে ছিলেন, তারা শেখ হাসিনার পতনের আগের দিন, যখন এক দফা দাবি তৈরি হলো, তখনই প্রশ্ন হলো, আচ্ছা, যদি আমরা যে দাবিটা তুলেছি যে শেখ হাসিনার পতন চাই, পদত্যাগ চাই, এরপরে আমরা কী চাই? এরপরে কী হবে? এবং সেই প্রশ্নের উত্তর শিক্ষকরাই দেবেন। সেই প্রশ্ন থেকে তারা একটা রূপরেখা তৈরি করেছেন এবং সেই রূপরেখা থেকে তারা একটা প্রস্তাবনা করেছেন। সেই রূপরেখার প্রস্তাবনা ছিল যে আমরা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পাশাপাশি আমরা একটা ছায়া সরকার গঠন করতে চাই, যেই ছায়া সরকার এই অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতার দায়বদ্ধতার মধ্যে, প্রশ্নের মধ্যে রাখবে, চ্যালেঞ্জের মধ্যে রাখবে, যেখানে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত হবে এবং এই ছায়া সরকারের মধ্যে সিভিল সোসাইটি থেকে শুরু করে সমস্ত সমস্ত ভিন্ন বর্গের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। একটা ডায়লগের মধ্য দিয়ে এটা হবে। এর মধ্যে আমাদের তাদের আরেকটা প্রস্তাবনা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ – সংবিধানের যেই বিধানগুলোর মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী সরকার গঠন হবার সুযোগ লুকিয়ে আছে সেগুলো আমাদেরকে প্রথমে সংশোধন করতে হবে এবং তার জন্য একটা অ্যাসেম্বলি তৈরি করা হবে, যেই অ্যাসেম্বলি কার্যত সংবিধানটা করবে। সরকার করবে না সংবিধান সংশোধন। সরকার একটি অ্যাসেম্বলি গঠন করবে এবং সেই সেই অ্যাসেম্বলি ওই সংশোধনটা করবে যাতে করে পরবর্তীতে কোনোভাবেই স্বৈরাচারী কোনো ব্যবস্থা তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগ না থাকে। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে এই সংস্কার না করে, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার না করে যদি আমরা আবারো পুরনো পথেই এগিয়ে যাই, তাহলে আমরা একইরকমভাবে আরেকটা স্বৈরাচারী সরকার কায়েম দেখতে পাবো। ফলে আমাদের কাছে এই সংস্কারটা অত্যন্ত জরুরি। তার জন্য পর্যাপ্ত সময় নেওয়া প্রয়োজন মনে করি। আমি অবশ্যই দুই বছর তিন বছর চাই না। ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে যদি করা সম্ভব হয় সেটা হবে সবচাইতে কাম্য।

তারা: নাসরিন যেটা বললেন, ছয় মাস বা এক বছরের মেয়াদটা মনে হয় একটা যুক্তিযুক্ত মেয়াদ। এই সময়ে তাদের ক্ষমতায় থাকতে হবে, কারণ অনেকগুলো ইনস্টিটিউশন পুনর্গঠন করতে হবে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা, অর্থনীতি সবকিছু তো খুব খুব খারাপ অবস্থায় এখন আছে। কমিউনিটি স্টেকহোল্ডারদের সাথে কথা বলতে হবে। কিন্তু একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। আমাদের বোধহয় গণমানসে এক ধরনের ধারণা রয়েছে যেটা নিয়ে কাজ করা দরকার। আমরা যেহেতু খুব ডেভেলপমেন্ট-ড্রিভেন একটা কমিউনিটি, যেহেতু আমাদের বাংলাদেশে প্রচুর এনজিও তৎপরতা আছে, আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট না। রাষ্ট্রব্যবস্থা একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। সেখানে গণমানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু থাকতে হয়। আমি যা দেখতে পাই সোশ্যাল মিডিয়াতে – আমাদের গণমানসের মধ্যে কিছুটা হলেও এমন একটা ভাবনা আছে যে উনারা করে দেবেন, উনারা সবকিছু ঠিক করে ফেলবেন। এটা প্লিজ ভাববেন না। এটা আরেকটা ইউটোপিয়ারই  অংশ যে আমাদেরকে কেউ একটা ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের মতো, এনজিও প্রজেক্টের মতো ইউএসএইডের টাকা দিয়ে একটি প্রজেক্টে আমাদের সবকিছু ঠিক করে দেওয়া হবে এবং আমরা তারপর সুখেশান্তিতে বসবাস করে আগামীতে এগিয়ে যাব। এরকমটা বোধহয় হবে না। যে ক্রোধটা ছিল স্টুডেন্ট প্রটেস্টের ভেতরে, যে ক্রোধটা ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ভেতরে, সেটা ঈদের মতো খুশি উদযাপন করে ক্রোধটাকে চলে যেতে দিয়েন না। সেই ক্রোধটাকে ধরে রাখেন। কারণ সেই ক্রোধটার এখনো দরকার আছে। নির্বাচন যদি এক বছরের মধ্যে হয় তারপরেও বহুদিন আপনাদের এই ক্রোধটার দরকার হবে। কারণ বাংলাদেশ ছ’মাস বা এক বছরের কোনো প্রজেক্ট হতে পারে না। সেনাবাহিনীর উপর আমাদের যে ভারী নির্ভরশীলতা, যেই আবেগ সেটাও কিন্তু খুব বিরক্তিকর একটা অবস্থা। এই যে মানুষ ভাবে সেনাবাহিনী কেন আসছে না, সেনাবাহিনী কেন এসে হাতে তুলে নিচ্ছে না, কিংবা কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে ছ’বছর থেকে সবকিছু ঠিক করে দিয়ে যাচ্ছে না, এমন প্রশ্ন করছে, এটা সমস্যাজনক। ছ বছর তিন বছরে কিছু ঠিক করে দেবে না কারো জন্য। আপনাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে। আরেকটি নির্বাচন আসবে, সেখানে যে ক্ষমতাধর্ম গোষ্ঠী আসবে তাদেরও অনেক সমস্যা থাকবে। সেখানেও কিছুটা যুদ্ধ করতে হবে, এই মানসিক প্রস্তুতি যদি আমরা নিতে অভ্যস্ত না হই, আমরা যদি ভীষণভাবে শুধু ডেভেলপমেন্টমুখী জাতি হিসেবে আশা করে বসে থাকি যে কোনো প্রজেক্টের মাধ্যমে সবকিছু আমাদেরকে করে দেওয়া হবে, তাহলে বোধহয় সেটা সুস্থতা হবে না। সেটা করতে হলেও এখন যে সরকার এসেছে, সেটা ছায়া সরকার হোক বা অন্য কোনো বিকল্প মডেল হোক, তার মাধ্যমে গণপরিসরে একটি আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। সে আলোচনাটা শুধু ফেসবুকে কিন্তু হবে না। সে আলোচনাটা সশরীরে কমিউনিটির মানুষদের করতে হবে। সে আলোচনাটার মধ্যে আপনি ঠিক না বেঠিক এই বাইনারির ভেতরে না গিয়ে বা আপনি আগে আওয়ামীলীগ করতেন, এখন ছাত্রজনতার পক্ষে এমন বাইনারির ভেতরে না গিয়ে বা আপনি দেশে থাকেন না, আমি দেশে থাকি, আমার অধিকার বেশি, সে বিষয়ে কথা বলার এ ধরনের বাইনারি থেকে বের হয়ে একটু যদি ফ্লেক্সিবল হয়ে একটি সামাজিক ডিসকোর্স তৈরি করা যায় আলোচনার, তাহলেই সাফল্য আসবে। আমাদের আসল লক্ষ্য একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা যে কাঠামোটা এই মুহূর্তে বাংলাদেশে একেবারেই নাই বিগত অনেক বছর ধরে। আশা করি যারা ইন্টারিম গভর্মেন্টে এসেছেন তারা সেই লক্ষ্যেই কাজ করবেন। ইন্টারিম গভর্মেন্ট কোনো প্যাকেজ ডিল হিসেবে বা প্রজেক্ট হিসেবে আমাদের সমাধান দিয়ে দিতে পারবে না। আমাদের স্টেকহোল্ডার, সিভিল সোসাইটি, গণমানুষ সবাইকেই তার জন্য কাজ করতে হবে।

নাফিসা: অনেক ধন্যবাদ। আমাদের সময় শেষ। অনেক ধন্যবাদ অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে আজকের আলোচনা শোনার জন্য। আলোচকদের বিশেষভাবে ধন্যবাদ খুব অল্প সময়ের নোটিসে এই অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সাহসী, সময়োপযোগী কিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য যেগুলো আমাদেরকে আগামী দিনে চলার চিন্তার খোরাক জোগাবে এবং আসলে কীভাবে কোন ইস্যুগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমাদেরকে লোকাল লেভেলে আমাদের কমিউনিটি মোবিলাইজ করতে হবে এবং ন্যাশনাল মোবিলাইজেশনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে সে ব্যাপারে ভাবতে অনুপ্রাণিত করবে। আজকের আলোচনা থেকে আশা করি আমরা বেশ ভালো কিছু চিন্তার খোরাক পেয়েছি। অনেক ধন্যবাদ সবাইকে। শুভ রাত্রি। ভালো থাকবেন।

সম্পাদনা: তৃষিয়া নাশতারান ও শবনম নাদিয়া


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *